টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টান্ত সিলেট সিটি করপোরেশন

প্রকাশিত: ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টান্ত সিলেট সিটি করপোরেশন

Manual5 Ad Code

বিশেষ প্রতিবেদক | সিলেট, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ : বাংলাদেশে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দৈনন্দিন বাড়তি বর্জ‍্যের পরিমাণ ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলছে। নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পরিবেশ দূষণ, জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ডাম্পিং রোধে কার্যকর, টেকসই ও বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। উন্নত দেশগুলো যখন এ বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করছে, আমরা তখন সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছি।

Manual6 Ad Code

এশিয়া ইউরোপ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১৫ বছরে শহুরে বর্জ‍্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হচ্ছে। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয় টন মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্ট তৈরি হতো, যা ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে ২৫ হাজার টন ছাড়িয়ে যায়। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর জন্য এ বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যখন সামগ্রিক চিত্র, তখন টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। দেশের প্রথম ও একমাত্র সিটি করপোরেশন হিসেবে বর্জ‍্যের টেকসই ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষ লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির একটি ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি। এ ফ্যাসিলিটি স্থাপনে এবং বর্জ‍্যের টেকসই সমাধানে সিলেট সিটি করপোরেশন পাশে পেয়েছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশকে। একটি প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত শহর সিলেটবাসীকে উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করছে তারা।
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৭৫ টন বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য তৈরি হয়, যার একমাত্র ঠিকানা লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ড। বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এসব বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সংগ্রহের পর কিছু রিসাইক্লেবল পণ্য তারা আলাদা করেন এবং বিক্রি করেন। বাকি সব অপচনশীল বর্জ্য নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয় এ ডাম্পিং গ্রাউন্ডে, যার আয়তন প্রায় আট একর। সেখানে ডাম্প করা রয়েছে আনুমানিক ৮ লাখ টন বর্জ্য। এ বর্জ‍্যের টেকসই সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ একলীম আবদীনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকরী কোনো সমাধান আসেনি। বাংলাদেশে একমাত্র লাফার্জহোলসিমের ছাতক প্ল্যান্টে আমদানি বিকল্প পণ্য ক্লিঙ্কার উৎপাদন হয়। ক্লিঙ্কার তৈরির সুবিধা থাকায় এ প্ল্যান্টে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে। এর সুবিধার নাম জিওসাইকেল। বাংলাদেশে জিওসাইকেলের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক লতিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়। এরপর শুরু হয় সিলেটে লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি বসানোর কাজ। ফ্যাসিলিটি বসানোর পর তা উদ্বোধন করা হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং এখান থেকে বর্জ্য নেওয়া শুরু হয় ২০২৪ সালের ১৪ মে।

লতিফুর রহমান আরও জানান, প্রতিদিন গড়ে ৬০ টনেরও বেশি বর্জ্য এ ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ছাতকে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের সিমেন্ট প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। আগামীতে এর পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির। এ ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের অপচনশীল দ্রব্য, বিশেষ করে প্লাস্টিক ও পলিথিন আলাদা করা হয় এ ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে। তারপর কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা নিয়ে যাওয়া হয় সিমেন্ট প্ল্যান্টে। এ ডাম্পিং গ্রাউন্ডের সব বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করতে সাত থেকে আট বছর সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি। সিমেন্ট প্ল্যান্টে ই-বর্জ্যগুলো নিয়ে তা সিমেন্ট কিলনে প্রেরণের উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর তা বিশেষ একটি ফিডারের মাধ্যমে সিমেন্ট কিলনে পাঠানো হয়। এই কিলনে ক্লিংকার তৈরির জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।এ তাপমাত্রায় সব বর্জ্য কো-প্রসেস হয়ে যায় যার কোনো অবশিষ্ট পরিবেশে ফেরত আসে না। বর্তমানে জিওসাইকেল প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরে প্রায় এক লাখ টন বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। এর সক্ষমতা বাড়াতে এরই মধ্যে পরিকল্পনা নিয়েছে কোম্পানিটি।

Manual6 Ad Code

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘লাফার্জহোলসিম জিওসাইকেল প্রযুক্তির মাধ্যমে যে সেবা দিচ্ছে তা প্রশংসার দাবিদার। সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবিহীন একটি সবুজ নগরী উপহার দেওয়ার যে লক্ষ্য রয়েছে, তা অর্জনে লাফার্জহোলসিম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।’

Manual2 Ad Code

লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘লাফার্জহোলসিম সবসময়ই টেকসই উন্নয়নে বিশ্বাস করে। কোম্পানির টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমাধান জিওসাইকেল পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদিত এ ধরনের একমাত্র পদ্ধতি।‘ এর মাধ্যমে আমরা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা দিয়ে আসছি। আমাদের লক্ষ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বর্জ্যবিহীন দেশ উপহার দেওয়া।’ একই পদ্ধতিতে দেশের অন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে সহযোগিতা করতেও কোম্পানিটি আগ্রহী বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একটি প্রতিনিধি দল সিলেট সিটি করপোরেশনের ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি ও ছাতকে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের সিমেন্ট প্ল্যান্টে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ঘুরে দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করার পাশাপাশি একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে।

সিলেট সিটি করপোরেশনে এ ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তৎকালীন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করলেও সফলতা আসেনি। লাফার্জহোলসিমের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিটি বাস্তবসম্মত এবং এর মাধ্যমে উভয়েই লাভবান হচ্ছে।‘‌সিলেট সিটি করপোরেশনের এই উদ্যোগ দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে।’এ প্ল্যান্টের কার্যক্রম সচল রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণও করেন তিনি। এশিয়া ইউরোপ ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে পরিমাণ বর্জ্য প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে, তার শতকরা ৫৫ ভাগ যেখানে সেখানে ফেলা হয়। আর যতটুকু সংগ্রহ করা হয়, তার বড় একটা অংশ মাটিতে স্তূপ করে রাখা হয় কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হয়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এর নেতিবাচক ফলাফল মানুষ ভোগ করছে প্রতিনিয়ত। বর্জ্য অব্যবস্থাপনার অন্যতম কুফল জলাবদ্ধতা। শহরগুলোর খাল, ডোবা ও ড্রেন দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে না। অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হলো সচেতনতা বৃদ্ধি ও টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

Manual2 Ad Code

ইউএনএফপিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ অবস্থার জন্য প্রধান কারণ হলো দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে সমস্যাটি বাড়তে থাকবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code