জনগণ জয়ী না হলে সংগ্রাম শেষ হয় না

প্রকাশিত: ৪:১৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫

জনগণ জয়ী না হলে সংগ্রাম শেষ হয় না

Manual5 Ad Code

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |

সমাজ ও রাষ্ট্রে এখনকার প্রধান বিবেচনার বিষয়– কার হাতে টাকা আছে, কার হাতে নেই। যার টাকা আছে সে-ই ক্ষমতাবান; টাকা কোন পথে এসেছে তা কেউ জানতে চায় না। কেননা, জানাই বোধ করি অন্যায় হবে। ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে। সব টাকাই যদি অন্যায় পথে অর্জিত হয়, তাতেও যেন কারও কিছু বলার নেই।

Manual3 Ad Code

বৈষম্য ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। আগেও বৈষম্য ছিল; কিন্তু একাত্তরে জাতির সমষ্টিগত মানুষ যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ঘরের মেয়েরা নানাভাবে লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা চলে গেছে নিজ নিজ পুরোনো অবস্থানে, যে অবস্থান ইতোমধ্যে আগের তুলনায় ভালো হবে কী, আরও খারাপ হয়েছে। তারা কাজ পায়নি। অনেকে দুর্ভিক্ষে পড়েছে। আর যারা বিত্তবান তাদের সুবিধা হয়েছে। তারা একবার ধন বৃদ্ধির সুবিধা পেয়েছিল পাকিস্তান আসায়, আরেকবার পেল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। বিত্তবানদের যে অংশ যুক্ত ছিল ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, তারা তো উৎফুল্ল হলোই, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদেরও কোনো অসুবিধা হলো না। রাজাকারদের ভেতর চিকন আলীরাই শুধু ধরা পড়েছিল; স্ফীতরা সহজেই পুনর্বাসিত হয়ে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য, আদর্শের জোরে নয়; টাকার জোরে।

যুদ্ধে জনগণের জয় হয়েছে– এটা একাত্তরের শেষে এবং বাহাত্তরের শুরুতে সত্য ছিল। মনে হয়েছিল, বিপ্লব ঘটে গেছে। আমরা নতুন রাষ্ট্র তো বটেই, নতুন এক সমাজও পাব। জনগণ বলতে সেই মুহূর্তে ধনী-দরিদ্র সবাইকেই বোঝাত। কেননা, সবাই একসঙ্গে লড়ছিল একটি চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের ঐক্য তো টেকেনি। ধনীরা চলে গেছে ধনীদের জায়গায়, বাদবাকিরা পরাজিত মানুষের মতো ফিরে গেছে আগে যেখানে ছিল তার চেয়েও খারাপ জায়গায়।

গত ৫৪ বছরের ইতিহাস এ দেশে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার ইতিহাস বটে। ধনী হয়েছে উৎপাদন করে নয়, মূলত লুণ্ঠন করে। কাজটি হানাদাররা শুরু করেছিল, স্থানীয়রা তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। একাত্তরে জাতি বিভক্ত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও রাজকারে। তার পর থেকে বিভক্ত হয়েছে ধনী ও দরিদ্রে। ধনীরা জয়ী হয়েছে গরিবদের হারিয়ে দিয়ে। যেন ধনীকে আরও ধনী করার জন্যই সবকিছু ঘটেছে।
এমন তো কথা ছিল না। লড়াইটা তো কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার ছিল না। ছিল সার্বিক মুক্তির, যে মুক্তির মূল ভিত্তিটাই হওয়ার কথা ছিল অর্থনৈতিক– কেবল উন্নয়নের নয়; বৈষম্যহীনতারও। জনগণের আশা কেন তাহলে ভেঙে গেল খান খান হয়ে? গেল এ জন্য যে, সমাজ মোটেই বদলাল না। রয়ে গেল আগের মতোই। রাষ্ট্র বদলাল বটে, কিন্তু সে কেবল বহিরঙ্গ। ভেতরে সে রয়ে গেল আগের মতোই। সেই একই আমলাতন্ত্র, আইনকানুন, অফিস-আদালত, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, ধমক-ধামক, ঠাটবাট। শাসক বদলাল, কিন্তু শাসন বদলাল না।

Manual8 Ad Code

স্বাধীন বাংলাদেশে আশা ছিল, আমাদের রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক; তা হয়নি। রয়ে গেছে আগের মতোই আমলাতান্ত্রিক। আশা ছিল, এগোবে সমাজতন্ত্রের দিকে। সে পথ ধরেনি। আটক রয়ে গেছে পুঁজিবাদের সেই পুরোনো খুঁটিতেই। এ রাষ্ট্র পাহারা দেয় না মানুষকে; পাহারা দেয় বিদ্যমান শাসকশ্রেণিকে। সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। সেও রয়ে গেছে আগের মতোই। স্বভাবতই জয় হয়েছে বিত্তবানদের। তারাই ক্ষমতাবান। তারাই সর্বেসর্বা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে গত বছরের গণঅভ্যুত্থান; প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পর চিত্র প্রায় অভিন্ন।

সংগ্রাম-যুদ্ধ-গণঅভ্যুত্থানে কি ধনী ঘরের ছেলেরা থাকে না? থাকে না মধ্যবিত্ত তরুণ? অবশ্যই থাকে। কখনও কখনও এমন সময় আসে, সবাই রুখে দাঁড়ায়। কুণ্ঠা করে না; এমনকি প্রাণ দিতেও। মানুষের মধ্যে দুটিই প্রবণতা থাকে; একটা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির, অপরটি অন্যের সঙ্গে মেশার, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ করার। আন্দোলন-সংগ্রামে আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থানে বিজয় এসে যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। করে দেয় একাকী; অনেক ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ। বিত্তবান ঘরের যোদ্ধারা তখন ভাবতে শুরু করে নিজের কথা। নিজের কষ্ট, আত্মত্যাগ, স্বার্থ– এসব বিবেচনা সামনে চলে আসে। সে হয়ে পড়ে স্বার্থপর।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এটাই ঘটেছিল। যোদ্ধারা যোগ দিয়েছিল তাদের দলে যারা ব্যস্ত তখন নিজ নিজ আখের গুছিয়ে নেওয়ার কাজে। নতুন রাষ্ট্রে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘অনুকরণীয় আদর্শ’। মনে হয়েছিল জয় হয়েছে স্বার্থপরতার; আত্মত্যাগের নয়, সমষ্টির নয়; ব্যক্তির। অর্থাৎ বিত্তবানদের স্বার্থের।

Manual7 Ad Code

একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তরে এসে বড় বড় মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করলেন; বিষয় দাঁড়াল মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তির ভূমিকা। শিরোনাম হলো আমার একাত্তর কিংবা মুক্তিযুদ্ধ ও আমি। দৃশ্যমান হয়ে উঠল অসংখ্য আমি; হারিয়ে গেল সমষ্টিবদ্ধ আমরা। কবিতা লেখা বাঙালির অতিপুরাতন অভ্যাস। একাত্তরে তারা সবাই মিলে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিল। তারপর আবার সেই গীতিকবিতার প্রথাগত কাল; খণ্ড খণ্ড-টুকরো টুকরো বিজয়ের কাহিনি বলা। যে বিজয়ের মৃত রূপ এখন আমরা দেখছি বৈষম্য ও দুর্দশা বৃদ্ধির ভেতরে। বিজয়ীর বেশে যারা দৃশ্যমান তারা কি খুব উল্লাসে রয়েছে? না, তা নেই। উল্লাস নেই। তিন কোটি টাকারই হোক অথবা হোক এক কোটি টাকার গাড়ি; রাস্তায় নামালেই বিপদ। যানজট গ্রাস করে নেবে গতি। নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শাসকশ্রেণিকে বাস করতে হচ্ছে বাংলাদেশের দূষিত পরিবেশেই।
বন্যা কেবল বস্তিই ভাসাচ্ছে না; অভিজাত এলাকায় গিয়েও হানা দিচ্ছে, আবর্জনা ও দুর্গন্ধ সঙ্গে বহন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় তো শুধু, মানুষকেও তো তারা ভয় করে। মানুষকেই বরং বেশি ভয়। যে জন্য পাহারা বসাতে হয় দরজায় ও দেয়ালে, যেখানে যায় সশস্ত্র বাহিনী থাকে অগ্রে ও পশ্চাতে। আর দেশের বাইরে পা দিয়ে তো কথাই নেই। দেশে থাকতে যে যত বড় ভিআইপি কিংবা ভিভিআইপি হোক না কেন, দেশের বাইরে যে কোনো বিমানবন্দরেই পা দিক না কেন, বুক কাঁপে শঙ্কায়। অপমানের আশঙ্কাটা দেখা যায় ওত পেতে রয়েছে যেখানে-সেখানে।

জনগণ যদি জয়ী না হয় তাহলে বলা যাবে না– আন্দোলন, সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান শেষ হয়েছে। কারণ রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষ হওয়ার পরও থাকে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়ী হয়ে যারা জেঁকে বসে থাকে, তাদের পরাজিত না করে বৈষম্যমুক্তির পথে এগোনো সম্ভব নয়; এক পা-ও নয়। এদের গৃহবিবাদ এদেরই বটে; জনগণের নয়। জনগণের জোট এ-পক্ষের হবে না, যেমন হবে না ও-পক্ষেরও। কেননা, শাসকশ্রেণি আসলে এক ও অভিন্ন।
#

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Manual2 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code