অর্থনীতির মেরামত কীভাবে সম্ভব?

প্রকাশিত: ২:৩৫ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫

অর্থনীতির মেরামত কীভাবে সম্ভব?

Manual5 Ad Code

বিরূপাক্ষ পাল |

ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাইরের রূপ কোটাবিরোধিতা হলেও এর ভেতরের কারণ অর্থনীতি থেকেই উৎসারিত। এদেরকে শাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় অর্থনীতির দুই পাপ—বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এ দুই পাপকে যদি আওয়ামী লীগ সরকার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত, তাহলে তাদের এই দুর্ভাগ্যজনক বিদায় ঘটত না। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একটি রাজনৈতিক দল শেষতক গোয়েন্দা আর ব্যবসায়ীনির্ভর হয়ে পড়ল।

যদি গোয়েন্দা আর ব্যবসায়ীরাই কোনো শাসকের স্থিতি নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে কোনো সামরিক শাসনেরই ইতি ঘটত না। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতার শুরু আর শেষ—দুটোই ছাত্র-জনতার হাতে। গোয়েন্দারা যে সরকার আসবে, তাকেই অবুদ্ধি দেবে। আর ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেছেন।

সমস্যা হয়েছে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। তাঁরা সরকার পরিবর্তনে ভোল পাল্টাতে পারেন না। ভালো ডাক্তার যেমন শরীরের সমস্যার কথা বলেন, অর্থনীতিবিদেরাও তেমন শরীররূপী অর্থনীতির সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে থাকেন। সেগুলো অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে উপাদেয় নয় বলে অর্থনীতিবিদেরা সরকারের শত্রুপক্ষে পরিণত হন। কখনো কখনো তাঁদের তাচ্ছিল্যের সুরে ‘সুশীল’ বলে বিদ্রূপ করা হয়।

ম্যাক্রো অর্থনীতির গুরুজন মেনার্ড কিন্স বলেছিলেন, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদেরাই এই সমাজের অধিকাংশ বিষয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। এর বাইরে অতি অল্প লোকই প্রভাবক হতে পারেন।

কিন্স যে সমাজে বড় হয়েছেন, সেখানে তিনি দেখেছেন, রাজনীতিকেরা তাঁর কথা শুনতে আসেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অর্থনীতিবিদদের ডাকতেন, কথা শুনতেন।

গর্ব করে চার্চিল একবার বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশদের “কমনসেন্স” উত্তম। তার প্রমাণ আমাদের কিন্স।’ দুর্ভাগ্য আমাদের যে এই সমাজে রাজনীতিক-অর্থনীতিবিদদের সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়ার মতো, যেখানে অর্থচিন্তকদের অবস্থা কুমড়ার মতো—শুধু অবজ্ঞা আর আঘাতের শিকার। এর বড় কারণ, তাঁরা কেন উন্নয়নের তালিকা দিনে একবার করে পাঠ করেন না।

রাজনীতিকেরা জানেন না যে উন্নতির গল্প করার জন্য একটি আলাদা শাস্ত্র রয়েছে, তার নাম উন্নয়ন অর্থনীতি। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রের নাম চলমান ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনা, যেখানে সমূহ ব্যর্থতা সরকার হটিয়ে দিতে পারে। উদাহরণ শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ।

আজ অর্থনীতির মেরামত শুরু করতে হবে ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনা দিয়ে। স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতি দমন, নিরাপদ রিজার্ভ রক্ষণ, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ, লেনদেনের ভারসাম্যে আনুপাতিক সুস্থিতি আনয়ন এবং খানিকটা মধ্য মেয়াদে বেকারত্ব কমানোর অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য জরুরিভাবে দরকার। এ জায়গাগুলোয় বিগত সরকারের ব্যর্থতা ছিল বললে ভুল হবে। ছিল প্রচণ্ড অবজ্ঞা, ছিল বৈপরীত্য।

Manual8 Ad Code

সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস বেকারত্বের নানা স্তরীয় সংকটগুলো তুলে ধরেছিল। সেখানে শিক্ষিত যুববেকারত্ব ছিল ভয় পাওয়ার মতো সংখ্যা। আসলে শিক্ষিত যুবশক্তির প্রায় অর্ধেকই বেকার। পরিসংখ্যানে গলা চিপে কমিয়ে রাখা হয়েছে। রাজনীতিকদের ভাষণে শুধুই তরক্কির ফিরিস্তি। ‘বেকারত্ব’ শব্দটি ছিল ভাশুরের নামের মতোই পরিত্যাজ্য।

সরকারি চাকরি মোট কর্মকাঠামোর শতকরা ৫ শতাংশও মেটাতে পারে না। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির কারণে ব্যক্তি খাতের সুস্থ বিকাশ হচ্ছে না। তারপরও ব্যক্তি খাত সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনেক যুবকের চাকরি অনেকটা দাসত্বের সমতুল্য। বাকি যুবকেরা সরকারি রাজনীতিতে যোগ দেয়। সরকারদলীয় ছাত্রনেতারা গাড়িতে করে ক্যাম্পাসে যায়। পেছনে মোটরবাইকের মিছিল। নেতাদের কোনো আয় থাকে না, কিন্তু ধনাঢ্য হতে বাধা নেই।

এরা নির্বাচনে গেলে পাস করবে না বলেই ছাত্রসংসদের নির্বাচন বন্ধ—যুগের পর যুগ। যার যার এলাকার পাতিনেতার পেছনে মোটরবাইকের সারি দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন মোটর শোভাযাত্রা আমি একজন পথচারী হিসেবে ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পেছনেও দেখিনি।

Manual4 Ad Code

একটি গাড়ি ভেঙে গেলে তার মেরামত প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতি সে জায়গায় শান্ত অবস্থায় বসে নেই। এখানে চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে গাড়িটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খাদে পড়ে যাচ্ছে। এই পতন আগে ঠেকাতে হবে। মূল্যস্ফীতি দমন ও রিজার্ভের নিরাপত্তা বিধান প্রথম দায়িত্ব এই অন্তর্বর্তী সরকারের। উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দগুলো আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি কিংবা দারিদ্র্যসূচকে বাংলাদেশের উন্নতির কথা সরকারি রাজনীতিকেরা যত উৎসাহী হয়ে প্রচার করেছেন, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, উদ্ভাবন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষার মান ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষের সূচকগুলোয় দুরবস্থার কথা তার চেয়েও বেশি হারে উপেক্ষা করেছেন। শেখ হাসিনা সরকারকে সেখানেই ধরা খেতে হলো।
আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল। কারণ, দুর্নীতি ও অদক্ষতা ৫০ শতাংশ অর্থ গ্রাস করে। পুতিন কর্তৃক গছানো এবং আমাদের কতিপয় আমলা ও রাজনীতিকের ব্যক্তিগত স্বার্থে আমদানি করা রূপপুরের পারমাণবিক প্রকল্প এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বিশ্ব যখন সভ্যতাগত নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো বর্জন করছে, তখন আমরা সর্বোচ্চ ঋণ—১৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সম্ভাব্য বাঙালিবিধ্বংসী এই বন্য হাতি নিয়ে এসেছি। সেটি এনেছি এমন এক স্বৈরাচারী পুতিনের কাছ থেকে, যিনি যেকোনো সময় যেকোনো চুক্তিতে পল্টি মারতে পারেন।

Manual3 Ad Code

সরকারের যদি আইনগত সুবিধা থাকে, তাহলে কালোটাকা সাদা করার যে বিধান বাজেটে পাস করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। ব্যাংকে পরিচালকসংক্রান্ত অশুভ বিধানটিও বাতিলযোগ্য। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার সুবিধাটি চরমভাবে বৈষম্যমূলক। রাজস্ব-দুর্বল একটি রাষ্ট্রে এটি এক অনৈতিকতার দৃষ্টান্ত। সোজা কথা, বাজেট নিয়ে বসতে হবে এবং এর যথাস্থানে সংশোধন প্রয়োজন। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের অঙ্ক কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এভাবে সমাজে অহেতুক মুদ্রাবর্ধক সিদ্ধান্তগুলো বাতিল না করলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।

বিগত সরকার কী কী ভুল করেছে—এগুলো নিয়ে রচনা লেখার অভিপ্রায় মনে হয় কোনো অর্থনীতিবিদের নেই। কারণ, আজ কোনো কিছুই তাঁরা নতুন করে বলছেন না। গত চার বছরের সব মিডিয়ার দলিলগুলো সংগ্রহ করলে দেখা যাবে যে অর্থনীতিবিদদের কোনো কথাই সরকার শোনেনি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের গলাধাক্কা খাওয়ার আগপর্যন্ত সরকার মূল্যস্ফীতি দমন, ডলারের মূল্য নির্ধারণ, সঠিক রিজার্ভ প্রতিপালন, সুদের হারের ন্যায্যতা বিধান—এর কোনোটিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেনি। এর কারণ দুটি।

এক. ধনিকতুষ্টির ধ্রুবতারা ঠিক রাখতে গেলে যা করতে হয়, তাই করতে হবে—এই নীতি গোঁয়ার্তুমির দর্শন।

Manual6 Ad Code

দুই. অযোগ্য কিন্তু পরীক্ষিতভাবে অনুগত লোককে প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসানো। যে পদগুলো বৈশ্বিক বিচারে জ্ঞানগত নেতৃত্ব পাওয়ার দাবিদার, সেখানে ঢালাওভাবে অনুগত আমলাদের বসানো হলো। সর্বত্র একাডেমিক বিতাড়নের মহোৎসব। কারণ, তাঁরা জ্ঞানপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিলে সেগুলো রাজনৈতিকভাবে অধিকাংশ সময়ে উপাদেয় নয়। তাহলে কি আমলাদের জ্ঞানপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই? না, তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু লুটেরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ কিংবা নাখালপাড়ার বণিকপতির যেকোনো সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠানপ্রধান আমলা যত সহজে শিরোধার্য করবেন, যোগ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত জ্ঞানী মানুষটিকে তত সহজে মাথা নত করানো যাবে না।

বাজার অর্থনীতি বা প্রতিযোগিতার অর্থনীতিতে যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে কোটা বা যেকোনো মূল্য নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতিতে অদক্ষতা বাড়ায় এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে না। এ–জাতীয় অর্থনীতিবিদকে কেউ ‘ড্রাগ অ্যাডিক্ট’ বা ‘রাজাকারের বংশধর’ বললে কিছু যায়–আসে না। অণু অর্থনীতি বা বাণিজ্য অর্থনীতির শ্রেণিকক্ষে এগুলো আমাদের পড়াতে হয়। একটি সমাজে জ্ঞাননির্ভরতা কমে গেলে তার বিপদ হবেই।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি কিংবা দারিদ্র্যসূচকে বাংলাদেশের উন্নতির কথা সরকারি রাজনীতিকেরা যত উৎসাহী হয়ে প্রচার করেছেন, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, উদ্ভাবন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষার মান ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষের সূচকগুলোয় দুরবস্থার কথা তার চেয়েও বেশি হারে উপেক্ষা করেছেন। শেখ হাসিনা সরকারকে সেখানেই ধরা খেতে হলো।

প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে গেলে অর্থনীতির মেরামত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন দেবে, এ নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের প্রচণ্ড আকুলতা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাদের মানতে হবে যে বর্তমান সরকারকে যোগ্য সময় দিতে হবে, যাতে অন্তত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গতিশীল করা যায়, এদের জন্য কিছু নীতিমালা তৈরি করা যায়, যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি মেরামতে অবশ্যই প্রয়োজনীয়।

#
বিরূপাক্ষ পাল
অর্থনীতিবিদ, প্রাক্তন ব্যাঙ্কার এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতি ও অর্থ বিভাগের অধ্যাপক।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code