জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক : একজন দার্শনিকের জীবনানুশীলন

প্রকাশিত: ১২:২৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২৫

জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক : একজন দার্শনিকের জীবনানুশীলন

Manual1 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে যে কয়েকজন মনীষীর উপস্থিতি যুগান্তকারী দীপ্যমান আলোর মতো ছড়িয়ে আছে, তাঁদের অন্যতম জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি শুধু একজন অসামান্য শিক্ষকই নন—একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিন্তাশীল মননস্রষ্টা এবং এক অনন্য জীবনাচারের মানুষ। জ্ঞানের প্রতি তাঁর নিবেদন, জীবনবোধ এবং ছাত্রদের প্রতি তাঁর নির্লোভ নিষ্ঠা তাঁকে আমাদের ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় একটি উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শৈশব, শিক্ষা ও অধ্যাপনা

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর—মতান্তরে ১৯১২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে তিনি ভর্তি হন ১৯৩১ সালে এবং ১৯৩৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ওই বিভাগে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগ থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পৃথক হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন।

পদোন্নতির প্রতি তাঁর ছিল চরম অনীহা। তাই দীর্ঘকাল তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে মনোনীত করলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন—তবে জ্ঞানের আড্ডা কখনও বন্ধ করেননি।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে গবেষণা : প্রত্যাশা, বেদনা ও প্রত্যাখান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কয়েক বছর পর তিনি পিএইচডি করতে যান লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে। সুপারভাইজার ছিলেন তৎকালীন খ্যাতিমান চিন্তাবিদ হ্যারল্ড লাস্কি। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ। কিন্তু হঠাৎই লাস্কির মৃত্যু আব্দুর রাজ্জাককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়—মনোজগতে আঘাত লাগে তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে। লাস্কির প্রতি শ্রদ্ধা, নিজের আত্মমর্যাদা, নতুন সুপারভাইজার মরিস জোন্সের সঙ্গে মতভেদ—সব মিলেই তিনি জমা দেওয়া থিসিস ফিরিয়ে এনে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন তাঁর মানসিক দিকনির্ভরতার প্রকাশ, অন্যদিকে প্রমাণ করে জ্ঞানতাপস রাজ্জাকের আপসহীনতা। পরে ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভিজিটিং ফেলোশিপের প্রস্তাব দেয়। ১৯৭৩ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি প্রদান করে।

জ্ঞানতাপস : জীবনাচার ও দার্শনিক মনন

জীবনকে তিনি বরণ করেছিলেন প্রাচীন স্টোয়িক দার্শনিকদের মতন; আহমদ ছফা তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—“রাজ্জাক সাহেবের মধ্যে এক ধরনের স্টোয়িসিজম আছে।” তাঁর জীবনযাপন ছিল অদ্ভুতভাবে সহজ—লুঙ্গি, খদ্দরের পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর আর বই-বোঝাই ঘর। তাঁর খাটের একটি পা ভাঙা ছিল; তিনি বই গুঁজে সেটির সমাধান করেছিলেন। তিনি বলতেন, “আমার তো আর জামাকাপড় নেই”—এ কথা তিনি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার আগেও!

জীবনযাপনের এই সরলতা শুধু ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়—এ ছিল তাঁর দর্শন, বোধ, আত্মসংযম এবং জ্ঞান-কেন্দ্রিক জীবনচর্চার প্রতিফলন।

Manual3 Ad Code

শিক্ষকদের শিক্ষক

ঢাকার ফুলার রোডের লাল ইটের দোতলা বাসায় দিন-রাত ছাত্রদের জ্ঞানসন্ধ্যার আড্ডা লেগেই থাকত। ক্লাস নেওয়ার প্রতি তাঁর অনীহা ছিল সত্যি; কিন্তু যখন কেউ জানার উদ্দেশ্যে তাঁর দরজায় কড়া নাড়ত—ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি কথা বলতেন।

তিনি কখনও কাউকে ‘তুমি’ বলেননি। সকল ছাত্রকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই—রাজনীতিবিদ, আমলা, অধ্যাপক, গবেষক, সাহিত্যিক—বলেছেন, তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন পথপ্রদর্শক ও মানস-দীক্ষার গুরু।

Manual3 Ad Code

একদিন এক তরুণকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, “এই ছেলেটি অর্থনীতি খুব ভালো বোঝে।” ছেলেটি ছিলেন ভবিষ্যতের নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক রূপকার

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য তিনিই প্রথম বিশ্লেষণ করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তাঁর ধারণা থেকেই জন্ম নেয় ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’—যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁকে বলা হয়—‘তাত্ত্বিক রূপকার’।

ডিক উইলসন তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন, খুশবন্ত সিং তাঁকে নিয়ে লিখেছেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট ডিগ্রি দিয়েছে। এর সবই তাঁর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতি।

Manual5 Ad Code

জীবনের নেশা : বই, বাজার আর রান্না

রাজ্জাক সাহেব বলতেন, “আমি যে কোনও দেশে গেলে দুটি জিনিস দেখি—কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান। এতে দেশের অবস্থা বোঝা যায়।”

বই পড়া ও সংগ্রহ ছিল তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। রান্না ছিল তাঁর আরেক নেশা। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর রান্না খেয়ে অভিভূত হত। এমনকি অনেক ছাত্র-শিক্ষকের স্ত্রীদেরও তিনি রান্না শিখিয়েছেন। রান্নার বইয়েরও বিশাল সংগ্রহ ছিল তাঁর।

দাবার বোর্ডে মনীষার লড়াই

অবসরের সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল দাবা। তাঁর সঙ্গী ছিলেন গণিতবিদ ও দাবাড়ু কাজী মোতাহার হোসেন। দাবার প্রতি তাঁদের এমন আসক্তি ছিল যে, কখনো কখনো রাতভর খেলে রাজ্জাক সাহেব বসেই থাকতেন মোতাহার হোসেনের ড্রয়িং রুমে। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য।

অসাধারণ মানবিকতা

অহংকার, প্রতিহিংসা, ক্ষোভ—কিছুই তাঁকে ছুঁতে পারেনি। সলিমুল্লাহ খান যিনি তাঁকে নিয়ে সমালোচনামূলক একটি বই লিখেছিলেন, তাঁর বিদেশযাত্রায় সুপারিশের চিঠি লিখেছিলেন রাজ্জাক সাহেব নিজেই! এমনকি বিমানভাড়ার অংশও বহন করেছিলেন। আহমদ ছফার বর্ণনায়—“এই ছিলেন রাজ্জাক স্যার।”

বিতর্ক, মামলা ও দৃঢ়তার প্রতীক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় উঠেছিল ‘আব্দুর রাজ্জাকের কল্লা চাই’ স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করেছিল। দুটিতেই তিনি জয়লাভ করেন। এটি ছিল স্বৈরাচারী প্রশাসনিক দমননীতির বিরুদ্ধে জ্ঞানীর নীরব বিজয়।

লেখালেখির অনীহা : তবু এক অনন্ত উত্তরাধিকার

জীবদ্দশায় তিনি তেমন কোনো বই লেখেননি। তাঁর মৌখিক শিক্ষাদানই ছিল প্রধান পথ। তাঁর চিন্তাধারা, দর্শন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ—সবই ছড়িয়ে আছে তাঁর ছাত্রদের স্মৃতিতে, তাদের রচনায়, তাদের কাজে।

বাংলাদেশে ‘বাঙালি মুসলমান’ ধারণা, জাতিসত্তা ও পরিচয়বোধ নিয়ে যে তাত্ত্বিক আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছে—তার অনেকটাই তাঁর মস্তিষ্কজাত।

উপসংহার : এক অনন্ত প্রেরণার উৎস

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক শুধু একজন শিক্ষক নন—তিনি ছিলেন জ্ঞানের দীপশিখা, বাঙালি মননের এক শিখর। তাঁর জীবন ছিল জ্ঞানার্জনের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত। সরলতা, সততা, নিষ্ঠা, দার্শনিক সংযম, মুক্তবুদ্ধির সাহস—এ সবকিছুর এক বিস্ময়সমন্বয় আমরা দেখতে পাই তাঁর মধ্যে।

২৮ নভেম্বর জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রয়াণ দিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাঁকে—যার জীবন আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে চিরকাল।
#

Manual2 Ad Code

লেখক :
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ