সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:২৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২০
|| রাশেদ খান মেনন || ১৯ নভেম্বর ২০২০ : চলে গেলেন আজীবন বিপ্লবী কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতা শফিউদ্দিন আহমেদ, আমাদের প্রিয় শফি ভাই। নারায়ণগঞ্জ শহীদ মিনারে তার বিদায় অনুষ্ঠানে ওই অঞ্চলের রাজনীতিক, শ্রমিক-কর্মচারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবীদের বিশাল সমাগম ঘটলেও এবং ঢাকা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হলেও সেই সংবাদ জাতীয় সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পায়নি। এমনকি মফস্বল সংবাদের পাতাতেও নয়। তার মৃত্যুর খবর জানিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের তরফ থেকে শোক সংবাদ পাঠানো হয়েছিল তাও উপেক্ষিত হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত শফিউদ্দিন আহমেদ শ্রমিক আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তার রাজনীতির মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে শ্রমিকের, শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। আমাদের দেশের রাজনীতিতে শ্রমিক আন্দোলনকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করে দেখা হয়। শ্রমিক সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অধীন অঙ্গ সংগঠন হিসেবে রাখা হয় (ক্ষমতা থাকলে তাদের) হুকুম পালনের জন্য শফিউদ্দিন আহমেদরা এই অদ্ভুতুড়ে ব্যবস্থার বাইরে শ্রমিক আন্দোলন ও সংগঠনকে তাদের অধিকারের দাবির ভিত্তিতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভিত্তিতে সংগঠিত করেছেন। আবার একই সঙ্গে ওই শ্রমিক আন্দোলনকে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার গণ্ডির বাইরে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনায়, সমাজতন্ত্রের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় ওই চেতনা যে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির গ্রাহ্যতা সেভাবে পাবে সেটি ধারণা করা যায় না।
অথচ এই শ্রমিকরাই এ দেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ দেশে আন্দোলনের ছয় দফার ভূমিকা সবার জানা। এই ছয় দফা প্রথমে যাদের রক্তে সিক্ত হয়েছে তারা হলেন এ দেশের শ্রমিকশ্রেণি। তেজগাঁওয়ের শ্রমিক মনু মিঞার জীবনদান ও আদমজীর শ্রমিকদের ছেষট্টির ৭ জুনের হরতালে অংশগ্রহণ ছয় দফাকে জনগ্রাহ্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি ছাত্র আন্দোলনে হলেও যার ব্যাপকতা লাভ করে টঙ্গী, চট্টগ্রাম, পোস্তগোলার শ্রমিকদের ঘেরাও আন্দোলনের মাধ্যমে। সত্তরের অসহযোগের সময় চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে কমরেড আবুল বাশারের সভাপতিত্বে শ্রমিকদের লাল পতাকার বিশাল শ্রমিক সভায় স্লোগান উঠেছিল, ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো পূর্ববাংলা স্বাধীন করো।’ টঙ্গীর শ্রমিকদের অংশগ্রহণে সত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা হয়েছিল, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ প্রতিষ্ঠার এগারো দফা কর্মসূচি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই শ্রমিক ও তার কৃষক ভাইয়েরা বীরোচিত লড়াই করেছেন। একইভাবে বাংলাদেশ-পরবর্তী এরশাদ শাসনবিরোধী লড়াইকে বেগবান করেছিল শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আন্দোলন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুসারে জাতীয়করণকৃত বস্ত্র-পাটকলসহ বিরাষ্ট্রীয়করণের বিরুদ্ধে এই শ্রমিকরাই দৃঢ় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। জীবন দিয়ে বিরাষ্ট্রীয়করণ ঠেকিয়েছিলেন।
এই প্রতিটি সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ও বাংলাদেশ-পরবর্তী ওই শ্রমিক-কর্মচারীদের নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন শফিউদ্দিন আহমেদ। তার শ্রমিক নেতৃত্বের শুরু সাধারণ বীমা কর্মচারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি প্রথমে ওই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। এর মাধ্যমে যুক্ত হন প্রথমে ‘গণতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলন’ ও পরে ‘জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশে’। কিংবদন্তি শ্রমিক নেতা কমরেড আবুল বাশারের মৃত্যু হলে তার ওপর জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সার্বিক দায়িত্ব পড়ে। তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এ ভূমিকায় তিনি শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। শ্রম আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে স্কপের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন এবং শ্রমিকদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনেন।
শফিউদ্দিন আহমেদের শ্রমিক আন্দোলনের মাঠের কার্যক্ষেত্র ছিল মূলত নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জের জুট প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন, আইসিআই শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় অবদান গার্মেন্ট শ্রমিকদের সংগঠিত করা। নারায়ণগঞ্জের নিট গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে মানবেতর অবস্থায় কাজ করতেন, তা থেকে তাদের উদ্ধার করে তিনি গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিশেষভাবে সংগঠিত করেন। পরে শ্রমিক আন্দোলনে কেন্দ্রীয় দায়িত্বে সময় দিতে হওয়ায় তিনি সে ক্ষেত্রে আর বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেননি। কিংবদন্তি শ্রমিক নেতা আবুল বাশারের মৃত্যুর পর পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বও তার ওপর এসে পড়ে। শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত পাটকল শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
নারায়ণগঞ্জে তার এই শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলাদেশ-পরবর্তী বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (লেনিনবাদী) সংগঠিত হলে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জে পার্টি সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন এবং সে হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ জেলা পার্টির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। লেনিনবাদী পার্টি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নাম নিয়ে প্রকাশ্য হলে তিনি প্রথমে ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও পরে পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এবং সেই দায়িত্বে তিনি দীর্ঘদিন পার্টির অডিট কমিটির প্রধান ছিলেন।
শফিউদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় কিডনিসহ অন্যান্য সমস্যা। এর ফলে শেষের দুই বছর তিনি পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। এ কারণে পার্টির গত বছরে অনুষ্ঠিত দশম কংগ্রেসে তিনি ওই পদ থেকে অব্যাহতি নেন। কংগ্রেস তার প্রতি সম্মান ও তার বিপ্লবী জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে আজীবন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে।
শফি ভাই নেই। কিন্তু তাকে বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি স্মরণে রাখবেন তাদের অকৃত্রিম বন্ধু ও নেতা হিসেবে।
#
রাশেদ খান মেনন এমপি
সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি