ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে নাকাল শ্রীমঙ্গল: সরানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

প্রকাশিত: ২:১৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৯, ২০২৫

ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে নাকাল শ্রীমঙ্গল: সরানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

Manual1 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ০৯ নভেম্বর ২০২৫ : মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে কলেজ রোডের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে বছরের পর বছর ধরে থাকা পৌরসভার ময়লার ভাগাড় এখনই অন্যত্র স্থানান্তরের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। দুর্গন্ধে নাকাল হয়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।

Manual7 Ad Code

রোববার (৯ নভেম্বর ২০২৫) সকালে কলেজ রোডে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ, দি বাডস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও গাউছিয়া শফিকিয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

Manual5 Ad Code

ফেস্টুন, ব্যানার ও স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে কলেজ রোড। বিক্ষোভ মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শ্রীমঙ্গল চৌমুহনায় সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেন।

সাত বছরের দাবি, আশ্বাসের পরও কাজের কাজ কিছুই হয়নি

২০১৮ সাল থেকেই স্থানীয় শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী বারবার মানববন্ধন, স্মারকলিপি ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে ভাগাড় স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

শিক্ষার্থী নেতা জাকারিয়া, উৎস, নুরুল আমিন ও নাফিজ বলেন, “প্রতিবারই আমাদের বলা হয়—‘শিগগির ভাগাড় সরানো হবে’। কিন্তু সাত বছর কেটে গেলেও আজও দুর্গন্ধের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কেউ কথা রাখেনি।”

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “এটা নতুন কোনো দাবি নয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করছি। ডিসি থেকে শুরু করে মেয়র—সবাই আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু ভাগাড় এখনো আগের জায়গাতেই। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় অবিলম্বে ভাগাড় সরানো জরুরি।”

দুর্গন্ধ, মশা-মাছি ও রোগবালাইয়ে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

প্রতিদিন পুরো পৌর এলাকার আবর্জনা ফেলা হয় কলেজ রোডের এই ভাগাড়ে। দুর্গন্ধ এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশে হাজারো মানুষ বসবাস করছেন—যাদের জীবনে দুর্গন্ধ, মশা-মাছি ও নানা রোগের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।

Manual2 Ad Code

তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন এই দুর্গন্ধ সহ্য করে ক্লাসে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, “ভাগাড়ের চারপাশে ময়লার পাহাড় তৈরি হয়েছে। বাতাসে মিশে দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ, জ্বর, ডায়রিয়া লেগেই আছে।”

সরেজমিন দেখা গেছে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নাক-মুখে রুমাল বেঁধে চলাচল করছেন। ময়লার স্তুপে প্লাস্টিক, পলিথিন, পরিত্যক্ত খাবার, হোটেলের পচা আবর্জনা—সব মিলিয়ে দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। ধোঁয়া ও দূষণে শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

দীর্ঘ ৯০ বছরের পৌরসভা, পরিবেশবান্ধব স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন নেই

শ্রীমঙ্গল পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে মাত্র ২.৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনে। ২০০২ সালে এটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও এখনো কোনো স্থায়ী আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ফলে পুরোনো ভাগাড়ই আজও শহরের প্রধান ডাম্পিং স্পট।

পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের জেটি রোড এলাকায় ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় ২.৪৩ একর জমি ক্রয় করা হয় নতুন ভাগাড় স্থাপনের জন্য। কিন্তু জমি নিয়ে আইনি জটিলতার কারণে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ ছিল। এরপরও প্রকল্পটি আর এগোয়নি।

২১ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প আটকে আছে অনুমোদনের অপেক্ষায়

শ্রীমঙ্গল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, “ভাড়াউড়া মৌজায় পৌরসভার নিজস্ব জমিতে আধুনিক স্যানেটারি ল্যান্ডফিল্ড ও ফ্যাকাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ২১ কোটি ২৮ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ইতিবাচক নির্দেশনা দিয়েছে, তবে প্রকল্প এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়।”

শ্রীমঙ্গল পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, “প্রকল্প অনুমোদন হলেই ময়লার ভাগাড় সরানোর কাজ শুরু হবে। এতে শ্রীমঙ্গলের ৫০ হাজার পৌরবাসী ও আশপাশের মানুষের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নতি ঘটবে।”

“এটি শুধু ময়লার সমস্যা নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের সংকট”

Manual3 Ad Code

আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “পর্যটননগরী শ্রীমঙ্গলের মতো শহরে কলেজ রোডে এমন দুর্গন্ধময় ভাগাড় লজ্জাজনক। এখানে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ে। এদের পড়াশোনার পরিবেশই ধ্বংস হচ্ছে। সরকারকে অবিলম্বে আধুনিক রিসাইক্লিং প্রকল্প গ্রহণ করে ভাগাড় স্থানান্তর করতে হবে।”

পর্যটন শহরের ভাবমূর্তিও ঝুঁকিতে

চা, পাহাড় আর পর্যটনের জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল এখন দুর্গন্ধ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থায় পরিচিত হয়ে উঠছে। স্থানীয় পর্যটন উদ্যোক্তারা বলছেন, তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মুখেই যদি এমন দৃশ্য ও গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে এটি পুরো এলাকার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে।

শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের একটাই দাবি: ‘ভাগাড় সরান এখনই’

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এক কণ্ঠে বলেন,
“আমরা কোনো রাজনৈতিক দাবি করছি না। শুধু সুস্থভাবে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পরিবেশ চাই। নোংরা ভাগাড়ের পাশে আমাদের ভবিষ্যৎ আটকে থাকতে পারে না।”

উপসংহার: তড়িৎ পদক্ষেপের দাবি

দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাসের পর আশ্বাস পেয়েও বাস্তব সমাধান হয়নি। এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নতুন করে আলোচনায় এসেছে শ্রীমঙ্গলের পুরোনো এই ময়লার ভাগাড়।
পরিবেশবিদ ও নাগরিকরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারি প্রকল্প অনুমোদন ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ