বিডার নিকোটিন কারখানার অনুমোদন আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন: জনস্বাস্থ্য পরিপন্থী সিদ্ধান্তে ক্ষোভ

প্রকাশিত: ১:৩০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২৫

বিডার নিকোটিন কারখানার অনুমোদন আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন: জনস্বাস্থ্য পরিপন্থী সিদ্ধান্তে ক্ষোভ

Manual7 Ad Code
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ১০ নভেম্বর ২০২৫ : বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক বহুজাতিক কোম্পানি ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেডকে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়াকে ‘আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ এবং ‘সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিয়েছে দেশের শীর্ষ তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনসমূহ।

বাংলাদেশ টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যাডভোকেটস (বিটিসিএ) ও বাংলাদেশ অ্যান্টি টোব্যাকো অ্যালায়েন্স (বাটা) এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে— বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির পরিপন্থী।
বিডা চেয়ারম্যানের বক্তব্যে বিতর্ক
সম্প্রতি এক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, “আমি এই প্রযুক্তিগত বা জ্ঞানগত বিতর্কে যাচ্ছি না—একটি ‘পাউচ’ কি বিড়ির চেয়ে খারাপ বা ভালো, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে।”
বিটিসিএ ও বাটার মতে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন যে পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংগঠনগুলোর দাবি— সরকারের বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এমন জনস্বাস্থ্যবিরোধী পণ্যের অনুমোদন দিতে পারে না, বিশেষ করে যখন বিষয়টি আদালতের নির্দেশনা ও সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
আদালতের রায় ও সংবিধানের লঙ্ঘন
২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ (সিভিল আপিল নং ২০৪–২০৫/২০০১) এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে ঘোষণা দেয়— “দেশে নতুন কোনো তামাক বা তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না।”
বিটিসিএ ও বাটার দাবি, বিডা এই রায় উপেক্ষা করে ফিলিপ মরিসের নতুন নিকোটিন পাউচ কারখানার অনুমোদন দিয়েছে, যা সরাসরি আদালতের নির্দেশনা অমান্য।
সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব “জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ভেষজ ও দ্রব্য নিষিদ্ধ করা।”
সংগঠনগুলোর মতে, নিকোটিন পাউচ—এ নতুন ধরনের নেশাজাত পণ্য—এর উৎপাদন অনুমোদন সেই সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিপন্থী।
জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে যে নিকোটিন পাউচ “অত্যন্ত আসক্তিকর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” এবং “কোনোভাবেই নিরাপদ নয়”।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে (NCDs) ঘটছে, যেগুলোর অন্যতম কারণ তামাক ও নিকোটিনজাত পণ্য।
জনগণের চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজস্ব খরচে বহন করতে হয়, যা জাতীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বিডার অনুমোদন “যুবসমাজ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি” বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ অ্যান্টি টোব্যাকো অ্যালায়েন্সের সদস্য-সচিব সৈয়দা অনন্যা রহমান।
তিনি বলেন, “সরকার যেখানে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের যৌথ ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান আদালতের রায় ও জনস্বাস্থ্য নীতি উপেক্ষা করে ক্ষতিকর নেশাজাত পণ্যের অনুমোদন দিচ্ছে—এটি গভীরভাবে উদ্বেগজনক।”
নীতিগত সমন্বয় উপেক্ষা ও প্রশাসনিক প্রশ্ন
বিডা অনুমোদন প্রদানের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA), ও বাংলাদেশ মান সংস্থা (বিএসটিআই)-এর মত সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরামর্শ নেননি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলোর মতে, এটি সরকারি প্রশাসনিক নীতি ও সমন্বয় কাঠামোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তারা বলেন, বিডার কাজ কেবল বিনিয়োগ অনুমোদন নয়—পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ বিবেচনা করে বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষা করাও তাদের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব।
প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ দাবি 
বিটিসিএ ও বাটা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আহ্বান জানিয়েছে যেন তিনি অবিলম্বে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন এবং ফিলিপ মরিসের নিকোটিন পাউচ কারখানার অনুমোদন বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়— “জনগণের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা রক্ষার্থে এই অনুমোদন প্রত্যাহার করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।”
বিস্তৃত আলোচনার দাবি
স্বাস্থ্য ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, নিকোটিন পাউচের মতো নতুন পণ্যের অনুমোদন দেওয়ার আগে স্বচ্ছ জনআলোচনা ও বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন জরুরি ছিল।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে তামাকমুক্ত নীতির অগ্রযাত্রা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত, তখন এ ধরনের অনুমোদন বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করবে।
উপসংহার
বিডার অনুমোদনকে কেন্দ্র করে সরকার, আদালত, ও জনস্বাস্থ্য সংগঠনগুলোর অবস্থান এখন পরস্পরবিরোধী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় এসেছে জনস্বাস্থ্য নীতি ও বিনিয়োগ নীতির মধ্যে সমন্বয়ের—যাতে বিনিয়োগ হয়, কিন্তু জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ