পরিবর্তন অভিমুখী রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষার প্রয়োজনেই মহান বিপ্লবী অমল সেন পাঠ জরুরি

প্রকাশিত: ৭:১৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২

পরিবর্তন অভিমুখী রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষার প্রয়োজনেই মহান বিপ্লবী অমল সেন পাঠ জরুরি

| সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃত, তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম কিংবদন্তি নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রয়াত সভাপতি ও আজীবন বিপ্লবী কমরেড অমল সেন চলে গেলেন ১৯ বছর হয়। কমরেড অমল সেনের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ৯২ সালে তিন পার্টি (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি ও সাম্যবাদী দল) একীভূত হওয়ার জন্য ঐক্য কংগ্রেসে। পরবর্তীতে প্রতি বছর ঢাকায় পার্টির প্রোগ্রামে গেলে সুযোগ পেলেই খুব আন্তরিকতার সাথে কাছে টানতেন এবং দীর্ঘ সময় কথা বলতেন। তরুণদের সাথেই তাঁর সখ্যতা ছিলো বেশি। অথচ বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মানুষেরা তাঁকে বিশেষ চিনেন বলে মনে হয় না। বুর্জোয়া নেতারা যেভাবে প্রচারের আলোতে থাকেন, একজন পরিবর্তন প্রত্যাশী প্রগতিশীল কমিউনিস্ট নেতার এ দেশে সেই সৌভাগ্য হয় না। যদিও দেশের পরিবর্তন অভিমুখী ঘটনায় তাঁদের ভূমিকা অসামান্য। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান যুগ ও বাংলাদেশ সময়-এই তিন কাল ধরে তাঁর সংগ্রামী জীবন বিস্তৃত। এ দেশের রাজনীতি, সমাজ-সম্পর্ক ও আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন, তাঁর একটি সময়ের হিসাবেই তাঁকে অনন্য বিপ্লবী জীবনের অধিকারী বলতে হয়।

ব্রিটিশ আমলে কৈশোরে কমরেড অমল সেন যুক্ত হয়েছিলেন অগ্নিযুগের বাংলার যুব বিদ্রোহী সংগঠন অনুশীলনে। সেখান থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল কমিউনিস্ট পার্টিতে। আর এখানেই তিনি বেছে নেন কৃষকদের, সমাজের একেবারে নিম্নবর্গ কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ। এই নিম্নবর্গ কৃষকদের নিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন অভূতপূর্ব কৃষক সংগ্রাম, ইতিহাসে যা তেভাগা কৃষক আন্দোলন নামে খ্যাত। তেভাগার এই আন্দোলনে তাঁর অংশের কৃষক সংগ্রামীরা জমিদার, মহাজন আর ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়। সেই বিজয় ব্রিটিশ আমলের বিরুদ্ধে পাল্টা রাষ্ট্রের ভিত গড়ার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

কমরেড অমল সেন তাঁর তেভাগার সমীক্ষায় কিছু কথা লিখে গেছেন। বস্তুত কোনো আন্দোলন রাজনীতি ও সমাজ-সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষগুলোকে কীভাবে বদলে দেয়, নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন তার প্রমাণ। অমল সেন ওই কৃষকদের সংগঠিত করতে কৃষকের সবচেয়ে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে অবস্থান নিয়ে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। নড়াইলের এগারখান অঞ্চলের এই মানুষগুলো মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করলেও সমাজ-সভ্যতার কিছুই তাদের জানা ছিল না। অমল সেন কৃষকদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম সংগঠিত করতে গিয়ে ওই মানুষগুলোকে সেই উচ্চমানের জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন।

তেভাগা আন্দোলনের সময়েই ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। আর পাকিস্তানে তেভাগা সংগ্রামী কমিউনিস্টদের জায়গা হয় জেলখানায় অথবা আন্ডারগ্রাউন্ডে। তখন সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কমরেড অমল সেনরা সচেষ্ট ছিলেন নতুন সংগ্রাম গড়ে তুলতে। ভাষা আন্দোলন এ দেশের মানুষকে আবার বদলে দিল। জেলখানায় বসে তিনি স্বস্তিবোধ করলেন ঘটনাবলির এই মোড় পরিবর্তনে। কিন্তু ওই পাকিস্তানের জেলখানায় কমরেডদের এই জীবনশিক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার উপায় থাকেনি অমল সেনের জন্য। তবে ওই জেলখানাকেই আদর্শ বিদ্যাপীঠ বানিয়েছিলেন তিনি কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব কর্মীর জন্য। কেবল রাজনীতি নয়, রাজনীতি, সংস্কৃতি, নাটক, নাচ, গান, বাঁশি বাজানোর সবটাতেই মাতিয়ে রাখতেন কর্মীদের।

কিন্তু যখন রাজনীতির দুরূহ প্রশ্ন আসত, সেখানে অমল সেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথচলার আসল জায়গাটি বেছে নিতে ভুল করেন নি। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মস্কো-পিকিং বিতর্কে তিনি পিকিংয়ের সংশোধনবাদবিরোধী অবস্থানের সমর্থন করলেও অন্ধভাবে পথ চলতে রাজি ছিলেন না। আর এ কারণেই নকশাল পন্থার উদ্ভব ঘটলে এবং চীন তার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলেও কমরেড অমল সেন তা গ্রহণ করেন নি। বাংলাদেশের পিকিংপন্থী বলে পরিচিত ইপিসিপি (এম-এল) নকশাল লাইন অনুসারে শ্রেণিশত্রু খতমের নীতি গ্রহণ করলেও তিনি এর বিরোধিতা করেছেন দৃঢ়ভাবে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইপিসিপির (এম-এল) ভ্রান্ত লাইনকে প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। নকশালপন্থার চরম বিভ্রান্তির বিপরীতে এই সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত করে, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার শিবপুর অঞ্চল (দেখুন হায়দার আনোয়ার খান জুনোর একাত্তরের রণাঙ্গন-শিবপুর)।

কমরেড অমল সেনের এই অবস্থান সেদিন বহু কমিউনিস্ট তরুণ কমরেডদেরকে ভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু ওই রাজনীতি জনগণ থেকে কমিউনিস্টদের যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল, তার থেকে দীর্ঘ সময়কাল এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে উদ্ধার করা যায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে কমরেড অমল সেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে পার্টিকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার গ্রুপ) ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) এবং কমরেড অমল সেন তার সাধারণ সম্পাদক হন। এই লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিই দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯৮০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি নাম ধারণ করে।

কমরেড অমল সেনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের যতখানি চেনা, তা এই পার্টি সংগঠিত করার কাজের মধ্য দিয়ে। এ কাজে তাঁকে ডান-বাম উভয় দিক দিয়েই চরম বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে অমল সেনের নিজের কাজের অঞ্চল যশোর-নড়াইলে তাঁকে চরম বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। কিন্তু সব বাধা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ওয়ার্কার্স পার্টির বিকাশে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। অবশ্য ওয়ার্কার্স পার্টিতে তাঁর যাত্রা সরলরৈখিক ছিল না। এই ওয়ার্কার্স পার্টিকেও দুই দফা বিভক্তির মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে ঐক্যের ধারা অমল সেন অনুসরণ করতেন, তার ধারাবাহিকতায় ওয়ার্কার্স পার্টি আবার ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এবার তিনি সভাপতি হিসেবে পার্টির প্রধান হন। আর সাধারণ সম্পাদক হন কমরেড রাশেদ খান মেনন।

কমরেড অমল সেন একজন বিপ্লবী। ছিলেন ব্যতিক্রমী কিংবদন্তি জীবনের অধিকারী। বিপ্লব ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তিনি যেমন একনিষ্ঠ ছিলেন, একই সময়ে মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনবোধ, রসবোধ, জীবনকে উপভোগ করার শক্তি ছিল অতুলনীয়। তাঁর সংস্পর্শে এসে যেকোনো বয়সের মানুষ আনন্দ পেত। কি বয়স্ক, কি যুবক-কিশোর-শিশু-সবার কাছেই তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।

বিপ্লবের প্রয়োজনে কমরেড অমল সেনকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক পড়াশোনায় বিশেষ করে মার্ক্সীয় দর্শন ও তত্ত্বই শুধু নয়; সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক সবকিছুই তাঁর মনোযোগ পেয়েছে। এই বিনয়ী নম্র মানুষটি আবার সংগ্রামে ছিলেন দৃঢ়চিত্ত-সে রাজনৈতিক সংগ্রামই হোক, তাত্ত্বিক সংগ্রামই হোক।
আর্থ-সামাজিক আমূল পরিবর্তন অভিমুখী রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষার প্রয়োজনেই মহান বিপ্লবী অমল সেন পাঠ জরুরি।

২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি কমরেড অমল সেন চলে গেছেন। কিন্ত রেখে গেছেন এমন মহান এক আদর্শ, যার মৃত্যু নাই। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। কমরেড অমল সেন লাল সালাম।
১৪ জানুয়ারি ২০২২
#

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : rpnewsbd@gmail.com
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ