তামিলনাড়ুর ভেলোরে চার নকশাল ও দশ রুপি!

প্রকাশিত: ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ, মে ২৩, ২০২২

তামিলনাড়ুর ভেলোরে চার নকশাল ও দশ রুপি!

শরীফ শমসির |

গত শতকের সত্তরের দশকে ভারত- বাংলাদেশে নকশালপন্থীদের দাপট ছিল। ভারতের নকশালবাড়ীর কৃষক বিদ্রোহ একটি ফেনমেনন হিসাবে তরুণদের হৃদয় হরণ করেছিল; তাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন জীবন ও যৌবন, সমাজের একটা ওলট-পালটও চেয়েছিলেন; ভারতে এই আন্দোলন নতুন রূপে ঠিকে আছে, বাংলাদেশে তা এখন ইতিহাসের অন্তর্গত।
নকশালপন্থীগণ বাংলাদেশে আদৃত নন, আমি নিজেও নকশালপন্থী নই, মনে হয়েছে বাংলাদেশের নকশালপন্থীগণ বড় বেশী ভারতের অনুকরণে উৎসাহী, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। তাই নকশালপন্থীদের সাহস ও আত্মদান বীরের সম্মান পায়নি। এখন বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির উপর। বাংলাদেশের নকশালপন্থীদের অনেকর সাথে আমার সম্যক পরিচয় আছে; ভারতীয়দের সাথে পড়াশোনা করে, দুয়েক জনকে দেখছি, তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
তামিলনাড়ুর ভেলোরে খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হসপিটাল এর সামনে অটো স্টান্ড, শ্রমিক ইউনিয়ন (সিটু) রয়েছে। অটোর দাম ও আরোহী নেওয়া একটি শৃঙ্খলার মধ্যে, ভোক্তা হিসেবে আমি ভাড়ায় সন্তুষ্ট নই, ভয়ানক মধ্যবিত্ত আমি! নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝি না। অটো চালকের দু’পয়সা বেশি (হয়তো) ভাড়া আমার গাত্রদাহ!
তবুও ভেলোর থেকে যাত্রাপথে আমি প্রথমে একটি কবরস্থান দেখলাম, মুসলিম, পাশাপাশি খ্রিস্টান, কিন্তু এই দুই কবরস্থানের মাঝখানে আরেকটি কবর দেখলাম, চোখ ছানাবড়া! মুসলিম কবরে পবিত্র গ্রন্থের আয়াত, খ্রিস্টান কবরে ক্রুশ চিহ্ন আর মাঝের কবরে উজ্জ্বল লাল কাস্তে- হাতুড়ি। আমি চমকালেও বুজলাম এই কবরে শায়িত ব্যক্তি নকশালপন্থী না হয় পারে না, আমার বাংলাদেশী চোখ তা বললো। এই স্মৃতি আমি নিজের জন্য তুলে রাখলাম। কিন্তু পরের দিন হাসপাতালের সামনে দুপুরের তপ্ত রোদে দেখলাম লাল পতাকা হাতে তিনজন প্রৌঢ় লিফলেট বিতরণ করছেন আর চাঁদা তুলছেন। তিনজনের একজন নারী, দুজন পুরুষ, দেহাতী মানুষ, পল্লীর ছাপ। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন দল? বললো, সিপিআইএমএল। বুঝিলাম, মাওবাদী। বললাম, আমার বাড়ি, বাংলাদেশে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বললেন, আমরা নকশাল। তারপর তাঁরা চাঁদার বাক্সটা এগিয়ে দিল, আমি অনভ্যস্ত হাতে দশ রুপি কৌটায় ফেললাম। তাঁরা জনসভার জন্য চাঁদা তুলছেন। তাঁরা, আমরা নকশাল কথাটা বলেছিল, গর্ব ও মর্যদায়, যেন নগরের নকশাল।

তাঁদের সাথে কথা বলে এগিয়ে গিয়ে অনুতাপ হচ্ছিল, কেনো আরও কিছু রুপি দিলাম না! মধ্যবিত্তের আড়ষ্টতা! বাংলাদেশেতো এখন দশ টাকার চাঁদা চলে না।
আমার দেশ, বাংলাদেশ, এখন আমীর দেশ; এখানে জনগণ নিজেরা নিজেদের রাজনীতি করেন না, রাজনৈতিক দলগুলোই করে! জনগণ রাষ্ট্রের মালিক; কবে হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে কবরে শায়িত একজন ও তিন জীবিত নকশালের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হলো। আমার বাংলাদেশের দেহাতি মানুষের উঁচু মাথা ও মর্যাদাময় জীবনের কামনা বাড়ালো; এই চার নকশাল।

#
শরীফ শমসির
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি