ফেডেরালবাদ: প্যারিস কমিউনের গঠনতন্ত্র 

প্রকাশিত: ২:১১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২১, ২০২৪

ফেডেরালবাদ: প্যারিস কমিউনের গঠনতন্ত্র 

জেমস গিঁয়ুম |
অনুবাদ: অনিক সন্ধি |

সম্পাদকের নোট: ১৮৭১ সালের এপ্রিলে, Solidarité পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশ করেছিলেন জেমস গিঁয়ুম। প্রেক্ষাপট ছিল: কিভাবে ফেডারেটিভ নীতিমালার ভিত্তিতে প্যারিস কমিউন গড়ে উঠতে পারে।

প্যারিসে সংঘটিত বিপ্লবের সত্যিকারের চরিত্র এত স্পষ্টভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে অপরিচিত একজন ব্যক্তিও তা সহজে বুঝে ফেলতে পারবে।

প্যারিসের বিপ্লব হল ফেডেরালিস্ট।

প্যারিসের জনতা নিজ ইচ্ছা মত সংগঠিত হবার স্বাধীনতা চায়। তারা চায় না ফ্রান্সের বাকি অংশ তাদের বিষয়ে নাক গলাক। ঠিক তেমনি তারাও চায় না অন্যের বিষয়ে তারা নাক গলাবে বা মাতব্বরি করবে। তারা একই সাথে সবাইকে তাদের নিজ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন অনুযায়ী সংগঠিত হবার আহবান যানায়।

এরূপ বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত সংগঠন মুক্তভাবে যুক্ত হবে, বা অন্য ভাষায় ফেডারেটেড হবে, যাতে তারা একে অপরের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে।

বলে রাখা ভাল প্যারিসের এই ফেডেরালবাদকে যুক্তরাষ্ট্র বা সুইজারল্যান্ডের কথিত “ফেডেরালবাদের” সাথে মিশিয়ে ফেলা উচিৎ হবে না।

সুইজারল্যান্ড সাধারণ এক ফেডেরাল রাষ্ট্র। এই শব্দই আলোচিত দুই সিস্টেমের পার্থক্য বলে দেয়। সুইজারল্যান্ড একটি রাষ্ট্র। সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্রের দ্বারা সীমাবদ্ধ কতগুলোর জাতীর একক। তাই তার ফেডেরাল চেহারা থাকা সত্ত্বেও তার আসল সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সেই চূড়ার নিকটই একত্রিত। তার ক্যান্টনগুলো1 নিজস্ব একক ও সার্বভৌম সত্তা নয়। সেগুলো শুধু সুইস রাষ্ট্রের সম্পূর্ণটার একাংশ। একটা ক্যান্টনের নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই তাই তার সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনও2 নেই। তার বিধাননীতি ফেডেরাল সংবিধানে3 সীমাবদ্ধ। সেই ফেডেরাল সংবিধান কিন্তু কোন সত্যিকারের মুক্ত চুক্তি নয়। তার প্রতি সব ক্যান্টন আলাদা ভাবে সম্মতি দেয় নি। সব ক্যান্টনের উপর এই চুক্তি সংখ্যাগরিষ্ট ভোটের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন ক্যান্টনের ফেডেরাল চুক্তি নাকচ করার অধিকার নেই। তাদের ফেডারেশন থেকে বের হবার কোন অধিকার নেই। আবার কোন ক্যান্টন বিভাজিত হয়ে নতুন ক্যান্টন তৈরি করারও কোন স্বাধীনতা নেই, সম্প্রতি টেসসিন4 ক্যান্টনের সাথে যা হচ্ছে। একেবারে মামুলি কোন রাজনৈতিক বা সমাজবাদী আন্দোলন, যেমন কোন স্ট্রাইক, ফেডেরাল সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনের দোর প্রান্তে নিয়ে আসতে পারে।

অর্থাৎ সুইজারল্যান্ড শুধু নামেই ফেডারেশন। সুইজারল্যান্ডকে আসলে ফেডারেশন না বলে বিকেন্দ্রিক বললে আরো সঠিক হয়। সুইজারল্যান্ডের মিল পাওয়া যাবে ফ্রান্সে “১৭৮৯ এর নীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত” ১৭৯১ এর ভার্সাই এসেম্বলি-তে লিখিত সংবিধানের সাথে5 যা ফেডেরালবাদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার চেষ্টা করে কিন্তু পুরোপুরি তা পারে না।

প্যারিস কমিউনের দ্বারা ও মহান সমাজবাদী প্রুঁধোর6 বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা প্রণীত ফেডেরালবাদ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র ও জাতিতত্ত্ব প্রত্যাখান করে।

ফেডেরালবাদের কাছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের দ্বারা সীমাবদ্ধ জাতীয় ও ভূগৌলিক একক বলে কিছু নেই। সে শুধু চিনে কমিউন7 সমষ্টির ফেডারেশনকে। এ এমন এক সমষ্টি যার মূলনীতি শুধুমাত্র চুক্তিবদ্ধ দলগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। আর তাই জাতীয়তাবাদ ও ভূখন্ডের সীমা সে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে।

ফেডেরালবাদের সামনে কোন রাষ্ট্র নেই। কোন কেন্দ্রীয় শক্তি নেই, যা অন্য সংগঠনের উপর নিজের মহত্ত্ব কায়েম করে ও নিজের কর্তৃত্ব তাদের উপর চাপিয়ে দেয়। সংগঠনের সমষ্টিগত শক্তিই তার একমাত্র শক্তি। এই সমষ্টিগত শক্তি তাদের ফেডেরাল চুক্তি নিশ্চিত ও রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করে। কিন্তু এই চুক্তি সুইস বা যুক্তরাষ্ট্রীয় “ফেডেরাল” চুক্তির মত মামুলি চুক্তি নয়। এটি এমন এক চুক্তি যা নিশ্চিত করে প্রত্যেক চুক্তিকারী অন্য চুক্তিকারীর স্বার্থ রক্ষা করবে।8 আর এই চুক্তি প্রত্যেক স্বাক্ষরকারী সংগঠনের দ্বারা আলাদা ও এককভাবে নির্ধারিত। এই সমষ্টিগত শক্তি কখনো অন্য ফেডারেট করা সংগঠনের উপর মহত্ত্ব কায়েম করতে পারবে না যেমনটা রাষ্ট্র সমাজ ও কমিউনগুলোর উপর করে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ও জাতীয় রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে। কমিউনগুলো নিজের পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে ও সত্যিকারের নৈ-রাজ্য9 ফুটে উঠবে।

তবে এ ভাবার কারণ নেই যে রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদ দমনের পর ফেডেরালবাদ, স্বৈরাচারবাদ, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবাদ বা অহংকারবাদের10 জন্ম দিবে। মোটেও না, ফেডেরালবাদ হল সমাজবাদী। তার কাছে সংহতি ও স্বাধীনতা অবিচ্ছিন্ন। কমিউনগুলো সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসিত হলেও নানা কারণে যেমন নিজের স্বাধীনতাকে আরো ভালোভাবে সুরক্ষার জন্য অন্য কমিউনের সাথে সংহতির মাধ্যমে থাকবে। এই সংহতি হবে অন্তরঙ্গ যা নিশ্চিত হবে নানান ফেডেরাল চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি তাদের সাধারণ স্বার্থগুলো নির্ধারণ করবে। বড় বড় জনসেবা কর্মকান্ড, পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও বহিরাগত আক্রমনের সময় মিউচুয়াল এইড – এসব ফেডেরাল চুক্তি নিশ্চিত করবে।

ফরাসি জনতা তাদের দুর্দশা ও জুলুমের প্রতি জেগে উঠুক। সত্যের আলোয় তাদের চোখ আলোকিত হোক! ১৮৭১ সাল হোক সেই সাল, যে সালে তারা ফেডেরাল ও সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র কায়েম করে। ঠিক যেমন ১৭৯৩ ছিল সেই সাল, যে সালে তারা মানবাধিকার কায়েম করে। ইউরোপ, যে আজ জার্মান সাম্রাজ্যের কালো থাবার তলে11, সে ইউরোপে আবারো জ্বলে উঠুক সাম্য ও স্বাধীনতার অনির্বাণ আগুন।

1
সুইজারল্যান্ডের প্রশাসনিক এককগুলোকে ক্যান্টন বলা হয়। সুইজারল্যান্ডের ফরাসি নাগরিকগণ একে কমিউনও বলে।
2
নিজেকে শাসন করার অধিকার। ইংরেজিতে এই অধিকারকে বলা হয় Self-determination।
3
সুইস সংবিধান। পুরো নাম হল সুইস কনফেডারেশনের ফেডেরাল সংবিধান (The Federal Constitution of the Swiss Confederation)
4
Tessin Canton অপর নাম Ticino canton। সুইজারল্যান্ডের ২৬টি ক্যান্টনের মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯ শতকে (এই লেখাটির সময়কালে) টেসসিন সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে গরীব ও শোষিত অংশ ছিল এবং নিরক্ষরতার হার ছিল দেশের সর্বাধিক। স্বাভাবিকভাবেই এরূপ অন্যায় অত্যাচার প্রতিবাদের জন্য ও সার্বিক মুক্তির জন্য সেখানে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম নেয়। ১৮৭০-১৮৯১ পর্যন্ত ফেডেরাল সেনাবাহিনীকে সেখানে ডাকা হয় নানান বিদ্রোহ দমনের জন্য।
5
১৭৯১ এর ফরাসী সংবিধান ফরাসী জনতার শত বছরের স্বাধীনতা-সংগ্রামের রক্তে লিখিত সংবিধান। ইউরোপে প্রথমবারের মত এই সংবিধান মানবাধিকার ও সমানাধিকার কায়েম করে। প্রথমবারের মত তারা ঘোষণা করেঃ রাজা বা ঈশ্বর নয়, সার্বভৌমত্ত্বের সত্যিকারের উৎপত্তি হল জনগন।
6
পীঁয়ের জোসেফ প্রুঁধো। ১৯ শতকের বিখ্যাত ফরাসী সমাজবাদী ও অনেকের মতে প্রথম এনার্কিস্ট।
7
ফরাসী শব্দ কমিউন দ্বারা প্রশাসনিক একক বুঝালেও সমাজবাদী বা কমিউনিস্ট তত্ত্বানুযায়ী বিপ্লবের পূর্ববর্তী, মধ্যবর্তী ও পরবর্তী সময়ে এর স্বাস্থ্যবান বিকাশ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের গুরুত্ব ব্যাপক।
8
সিভিল ল’ তে এরূপ চুক্তিকে synallagmatic চুক্তি বলে। লেখাটির ইংরেজি ভাষান্তরে এই শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছিল।
9
নেই যার রাজ্য, নেই যার কর্তৃত্ত্ব। শাসন-শোষণ বিহীন এক স্বাধীন ও সাম্যবাদী সমাজ।
10
Egoism। লেখক খারাপ অর্থে এ শব্দ ব্যবহার করলেও জার্মান লেখক ম্যাক্স স্টার্নার কতৃক এই দর্শন পরবর্তীতে নৈরাজ্যবাদের দর্শন ও সাহিত্যে খুব গুরুপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
11
পুরো ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ তখন জার্মান সাম্রাজ্য ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পদতলে ছিল। সাম্রাজ্যবাদী দখলের জন্য যুদ্ধ লাখ লাখ মানুষের জীবন নাশ করেছিল। জার্মান সাম্রাজ্যের ফ্রান্স দখলের জন্য যুদ্ধের সময় তারা তার রাজধানী প্যারিস ঘেরাও করে। প্যারিসের জনতাকে জার্মান কসাইদের মর্জির উপর ছেড়ে দিয়ে ফরাসী সেনাবাহিনী ও শাসকগণ নির্লজ্জভাবে শহর ছেড়ে পালায়। কিন্তু ফরাসী জনতা কোনঠাসা হয়নি। বীরের মত তারা অস্ত্র তুলে নেয় ও ফরাসী কমিউন কায়েম করে। দুনিয়ার প্রথম সমাজবাদী বিপ্লব ছিল এটি। কিন্তু যে ফরাসী ও জার্মান সেনাবাহিনী ক’দিন আগেও একজন আরেকজনের গলা কাটছিল, তারা বিপ্লবের আভাস পেয়ে হাতে হাত মিলিয়ে প্যারিসে ঢুকে নির্বিচার গণহত্যা চালায়। অন্তত ২০,০০০ নিরীহ মানুষ শহীদ বরণ করে। প্যারিস কমিউন সাক্ষী, শাসক শ্রেণীর কোন জাতি নেই, দেশ নেই। তাদের স্বার্থ একটাই – পূঁজির কর্তৃত্ব বহাল রাখা। সে হোক জার্মান, ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান, রাশিয়ান, চীনা, সৌদি, ইরানি, ভারতীয় বা বাঙালি – জনতা যখন সার্বিক মুক্তির জন্য শেষ যুদ্ধ ঘোষণা করবে, শাসক শ্রেণী দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ সব ভুলে সেই যুদ্ধে জনগণকে পরাজিত করার জন্য একত্রিত হবে।

#

অনিক সন্ধি |

অনিক সন্ধি অরাজপন্থি অ্যক্টিভিস্ট। উনিশ শতক ও বিশ শতকের ধ্রুপদী নৈরাজ্যবাদের ইতিহাস ও তত্ত্ব তার মূল আগ্রহের জায়গা। লেখালেখির পাশাপাশি অনুবাদ করছেন। পড়াশোনা করছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মাসি বিভাগে। এছাড়া একটি মেটাল ব্যান্ডে ড্রামার হিসেবে কাজ করছেন।
যোগাযোগ: ‍anikshandhi1019@gmail.com