সৈয়দ আমিরুজ্জামান |
জাতীয় শোক দিবস আজ। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করে দিনটি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ ও মেয়ে বেবি, সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।
বস্তুত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়। গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারের ইতিহাস রচিত হতে থাকে।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনীদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী কারা তা আজ সুষ্পষ্ট। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রসহ চার মূলনীতি সংযোজনের কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত না হলে নয় মাসে স্বাধীন হতো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে অনেকেই বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তা চরম বেঈমানীর সামিল।
গত বছর (১৩ আগস্ট ২০২২) ঢাকায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি “বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড: অভ্যন্তরীণ ষড়ষন্ত্র ও মার্কিন যোগসাজশ” শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ব্যক্তি হত্যা ছিল না। ছিল না কিছু ‘বিপথগামী সেনা সদস্য’র হঠকারিতা। এই হত্যার জন্য ’৭২ সাল থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট তার বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পথভ্রান্ত হয়েছে, সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে অস্পষ্টতা রেখে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলংকমুক্ত করা যাবে না, শংকামুক্ত করা যাবে না।
ওইসভায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘৭৫ এর পটপরিবর্তন আমরা মানি না। ‘৭৫ এর পক্ষ বিপক্ষ আছে। আমরা ‘৭৫ এর হত্যাকান্ডের বিপক্ষে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন। এক কৌশলী নেতা হিসাবে সব কিছুকে সমন্বয় করেছিলেন। বাঙালী মন থেকে দ্বিজাতির তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান মনস্কতা দূর করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ‘৭২ সাল থেকে। পাকিস্তানের পরাজয় মেনে না নেয়ার পক্ষ এবং পুনরায় পাকিস্তানের পথে নিতে ‘৭৫ এর নৃশংস হত্যাকান্ড সংগঠিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিরাপদ করতে রাজনীতির বিষবৃক্ষ বিএনপির রাজনীতি উপড়ে ফেলার আহবান জানিয়েছিলেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল নেপথ্যের খলনায়কদের চিহিৃত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে ‘৭২ এ সংবিধান দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে সেই সংবিধান কাটাছেঁড়া করে হত্যা করেছে। পাকিস্তানের পরাজয় ওরা মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধু ধর্মের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। সামরিক শাসকরা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জুড়ে দেয়। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা আমাদের বিপক্ষে ছিল আজও তারা বিপক্ষে। সে দিন তারা জামাতের পক্ষে ছিল আজও তারা জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান বলেন, শুধু মার্কিন না তাদের দোসর পাকিস্তান ও তার মিত্ররা ‘৭৫ এর ঘটনাবলীর সাথে সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, বামপন্থী নেতা আব্দুল হক শেখ মুজিবর রহমানকে হটাতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সে সময়ের ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও তদন্ত করা দরকার।
তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির কারণে গড়ে ওঠা ১৪ দল যদি আদর্শিক জোট না হয় তাহলে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নতুন মিত্র হিসাবে আগামী জোট সঙ্গী হবে।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সৃষ্ট সংকটে জনগণের পক্ষে ১৪ দলের শরীকরা কথা বলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ১৪ দলকে ‘আদর্শিক জোট’ না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, এটা সঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যই ১৪ দল গড়ে উঠেছে যা পরিপূর্ণভাবে আদর্শিক। এখানে ভিন্নতা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যের কারিগরদের জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের আহবান জানান।
“বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড: অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও মার্কিন যোগসাজশ” শীর্ষক জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি’র লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের ৪৬ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। দু’দিন পর শোকাবহ পনেরই আগস্ট। এইদিন বাংলাদেশ ও সারাবিশ্ব পৃথিবীর অন্যতম নৃশংস হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছিল। এই দিন উষালগ্নে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। জাতির পিতার সকল আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা দানকারি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, পুত্রবধুগণসহ শিশু শেখ রাসেলও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায় নাই। রেহাই পান নাই তার ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যরা, ভাগ্নে যুবনেতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনিসহ তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবু নাসেরসহ বত্রিশ নম্বরে তার বাড়ির প্রহরা ও কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধুর উপর আক্রমণের খবর পেয়ে ছুটে আসা তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জামিলকেও এই হত্যাযজ্ঞে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতার ইতিহাস এখন সর্বজনবিদিত। তার আর বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নাই।
২। বঙ্গবন্ধু হত্যার বহু বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। দায়ী খুনীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। কিন্তু ঐ রায় বিচারিক প্রক্রিয়া পার হয়ে বাস্তবায়িত হতে বহু বছর সময় লেগেছে। এখনও হত্যাকারীদের বেশ কয়েকজন বিদেশের মাটিতে পলাতক জীবনযাপন করছে। এদের কয়েক জনের অবস্থান চিহ্নিত হলেও তাদের আশ্রয়দানকারী দেশসমূহের আইনের ম্যারপ্যাঁচে এইসব পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকার কথা বললেও বাস্তবে তার কোন ফলাফল নাই। এর একটি বড় কারণ হল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সত্য হলেও এর পিছনের ষড়যন্ত্র এখনও সঠিকভাবে উদ্ঘাটিত হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তার তিন দফার এই শাসনামলে পার্লামেন্টে ও পার্লামেন্টের বাইরে এই হত্যাকান্ডের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন, ঐ ষড়যন্ত্রের দায় নিরুপণের প্রতিশ্রুতি দিলেও অদ্যাবধি প্রতিশ্রুত একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় নাই এবং সেই ধরণের কোন কার্যকর উদ্যোগ আছে বলেও প্রতীয়মান হয় না।
৩। বঙ্গবন্ধুর এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পিছনের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকারীদের বিচারের পদক্ষেপ প্রথম থেকেই বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী খন্দকার মোশতাক পনেরই আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর ঐ বিচার বন্ধ করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। ইতিমধ্যে জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতি হয়েছে। অপরদিকে তেসরা ও সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইন বলে সংবিধান সংশোধন করে যে অর্ডার জারি করে তাতে মোশতাকের ঐ ইনডেমনিটি আইনকে সাংবিধানিক ছত্রছায়া দেয়া হয়। ১৯৭৯-এর দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, একতা পার্টির বিরোধিতা সত্বেও তা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
৪। ফলে ঐ বিচারকাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আইনের বাধা সৃষ্টি হয়। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাউত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার হত্যার পর বিচারের দাবি সেভাবে রাজনীতির এজেন্ডাভূক্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই তাঁর লাশ বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে রেখেই তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খুনী মোশতাকের মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের কর্ণধার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে গ্রেফতার ও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর তরুণ সহকর্মীদের গ্রেফতার করে তীব্র নির্যাতন করা হয়।
একই সময় এটাও সত্য যে দু’একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ সংঘটিত হয় নি। এই ব্যতিক্রমের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার অনুসারিদের নিয়ে ভারত সীমান্ত থেকে প্রতিরোধ গড়ার প্রচেষ্টা, বরগুনার এসডিও সিরাজুদ্দিন আহমদের ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে চারদিনের মত খন্দকার মুশতাকের অবৈধ সরকারকে অস্বীকার করা এবং ছাত্র অঙ্গনে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি ও মফস্বল শহরে প্রতিবাদ মিছিলের চেষ্টা।
৫। ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সকল রাজনৈতিক দল অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় দেশে আর কোন রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য ও আইনী অস্তিত্ব ছিল না। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ বাকশালে একীভূত হয়েছিল। অপরদিকে বিরোধীদল জাসদ, ইউপিপি ‘লেনিনবাদী পার্টি, বর্তমানের ওয়ার্কার্স পার্টি যার অন্তর্ভুক্ত ছিল’, জাগমুই আত্মগোপনে বাকশালের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগেই পনেরই আগস্টের ঘটনা ঘটে যায়। এটা ইতিহাসের সত্য যে, এইসব দল কেবল বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধী ছিল তাই নয়, মুজিব শাসনামলের সাড়ে তিন বছরে রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, স্পেশাল পুলিশ ও আওয়ামী লীগ দল দ্বারা চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছে, জেলে গেছে, হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। পাল্টা এই সব দলগুলোর মধ্যে জাসদ ১৯৭৪-এর শেষভাগে গণবাহিনী তৈরী করে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ গ্রহণ করেছিল। এর বাইরে সিরাজ শিকদার নিহত হলেও তার অনুসারি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিসহ গোপন অতি-বাম কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো তখনও ‘বিপ্লবে’র নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল।
৬। এই অবস্থা বাকশালের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি উত্থাপিত হয় নাই। বরং বহু বছর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের প্রশ্নটি রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ ও পাল্টাপাল্টির বিষয় ছিল। ফলে এই সময়কালে পুন:সংগটিত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপিত হলেও তা সাধারণ রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত হতে পারেনি।
৭। ইতিমধ্যে পনেরই আগস্টের ঘটনার সময় বিদেশে থাকায় জীবনে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন ও বিচারের জন্য বিদেশের মাটিতে ব্রিটিশ এমপি স্যার টমাস উইলিয়ামসকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু হত্যা তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ঐ ট্রাইব্যুনালকে বাংলাদেশে প্রবেশে অনুমতি দেয় নাই। বরঞ্চ স্যার উইলিয়াম টমাসকে বাংলাদেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। টমাস উইলিয়ামকে বলেছিলেন, চিলির পর বাংলাদেশে তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে।
৮। বস্তুতঃ ১৯৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা দলের হাল ধরে তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করেন। এদিকে প্রথমে জিয়া বিরোধী দশ দল ও এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী পনের দল গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়টি বিরোধী রাজনীতির অন্যতম এজেন্ডায় পরিণত হয়।
৯। এই সময়কালে সবসময় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার তরফ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কালোহাতের কথা স্পষ্ট করেই বলা হত এবং চিলির আলেন্দের মতই বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে একইভাবে সিআইএ-র হাত ছিল একথাও বলা হত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বিশেষ সোচ্চার ছিলেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ চৌধুরীর একটি বই রয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সে সময়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার সহায়তাকারী অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ সে পথ থেকে ক্রমশই দূরে সরে আসে এবং জিয়া-এরশাদ আমলে বরং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বৈরী নীতি অনুসৃত হয়। রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগও ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার দুরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। নব্বইয়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর আর কোন বাধা রইল না। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সিআইয়ের হস্তক্ষেপের বিষয়টি হারিয়ে যায়। এ বিষয়ে এখন আর বিশেষ কোন কথা শোনা যায় না।
১০। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখন সবার জানা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু মেজর, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার বাহিনী নিয়ে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে এই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়েছে ও তা কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এর সাথে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলেও সেই সব কুশীলবদের চিহ্নিতও করা হয় নাই এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয় নাই।
১১। সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্ট যে, সে সময়ের সেনা উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান এই মেজরদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানতেন। খুনী ফারুকের দেয়া সাক্ষাতকার অনুযায়ী জিয়াকে তাদের এই উদ্যোগের বিষয় অবহিত করলে তিনি তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন নাই বা বাধা দানের কোনরকম চেষ্টা করেন নাই। সেনা কর্তৃপক্ষ বা সরকার কাউকে তিনি বিষয়টি অবহিত করেন নাই। নিজে নিরাপদ থাকার জন্য বরং ঐ মেজরদের তাকে না জড়াতে বলেন। এবং নিম্ন পর্যায়ের অফিসাররা কিছু করলে করতে পারে বলে জানান। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি মনোভাব নেবে সে সম্পর্কেও খুনী রশীদ-ফারুককে মার্কিন দূতাবাসে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। এসব আমার কথা নয় ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকান্ড’ শীর্ষক বইয়ে অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক প্রয়াত মীজানুর রহমান খান বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আমি এখানে তার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখাকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। আমি সকলকে বইটি পড়তে বলব।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ছাড়াও ঐ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সেনা দপ্তরের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সকল বাহিনী প্রধানদের খুনী মুশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, পরবর্তীকালে ঐ সেনা প্রধানদের বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে মুশতাক সরকারে যোগদান ও তৎকালীন বিডিআর প্রধান জেনারেল খলিলুর রহমানের চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসাবে নিযুক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থনেরই পরিচায়ক।
১২। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যপটে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন খন্দকার মুশতাক। তিনি কতবড় বিশ্বাসঘাতক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ আগস্ট রাতে নিজ বাড়ির রান্না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়িত করার ঘটনায়। খুনী ফারুক-রশীদ বিশেষ করে খুনী রশীদ এই চক্রান্ত পর্বে সবসময়ই তার সাথে আলোচনা-পরামর্শ করেছে। চক্রান্ত বাস্তবায়নের দিন সম্পর্কে সাবধানতার কারণে মুশতাককে অবহিত করা না হলেও, তাকে যে পূর্ব মানসিক প্রস্তুতি দেয়া হয় তাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরপরই খন্দকার মুশতাক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজে ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে এতটুকু দেরি করেনি। দেশে তখনও সাংবিধানিকভাবে একজন উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু মুশতাক সরাসরি নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিয়ে তিনিই যে ঐ চক্রান্তের বেসামরিক হোতা তার প্রমাণ দিয়েছে। তার সাথে অতি দ্রুততার সাথে যুক্ত হয়েছে শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ। আর আমলাদের মধ্যে যুক্ত হয়েছিল মাহবুবুল আলম চাষী যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তের সাথে যুক্ত ছিল। সে সময়ের প্রধান আমলার কথা নাইবা বললাম, তিনি প্রয়াত। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর যারা দলে দলে ‘বাকশালে’ যোগ দিয়েছিল তারা এক মুহুর্তেই তাদের চেহারার পরিবর্তন করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ দূরে থাক তার বিরুদ্ধে নানারকম কটুকাটব্য করতেও দ্বিধা করে নাই।
১৩। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আজকের আলোচ্য বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মার্কিন যোগসাজশের বিষয়টি সম্প্রতি অবমুক্ত হওয়া মার্কিন দলিলসমূহে দেখা যায়। মীজানুর রহমান খানের ঐ বইয়ে ঐ সকল দলিলের ভিত্তিতে তিনি উল্লেখ করেছেন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরপরই ১৯৭২ সালে খুনী ফারুক অস্ত্র সংগ্রহের নামে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল। সে দূতাবাসকে জানিয়েছিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সেনাবাহিনীতে যে কমিটি করা হয়েছে তার প্রধান উপ-প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন। তাদের পক্ষ হয়ে দূতাবাসে সে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে যায়। ১৯৭৩-এ এই একই বিষয়ে সরাসরি মার্কিন দূতাবাসে আবার যোগাযোগ করেছিল। আর ১৯৭৪-এর এপ্রিলে এসে মেজর ফারুক-রশিদ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকার বিরোধী কোন অভ্যুত্থান হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কি মনোভাব হবে সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ সবই ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো টেলিগ্রাম ও রিপোর্টে উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে মার্কিন যোগসাজশ অনুসন্ধানরত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজের কাছে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জন বোস্টার বলেছিলেন যে, এ ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত সকলকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সিআইএ নিজ থেকে এ ব্যাপারে কোন ভূমিকা রেখেছিল কিনা তা তিনি বলতে পারেন নি। তবে ঢাকায় সে সময়ে সিআইএ-র স্টেশন চীফ চেরী বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে সিআইএ-র সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করে।
মীজানুর রহমান খান তার অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার বিষয় সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে না পারলেও এই হত্যাকান্ডে মার্কিনী হাত থাকার ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক লিফসুজ বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে জড়িত ছিল সে বিষয়টি তার লেখায় একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। তবে মীজানুর রহমান খান মনে করেন যে, ক্রমপ্রকাশমান মার্কিন দলিলসমূহে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
১৪। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই তা’হল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলেও এর পিছনে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী যোগসাজশের ব্যাপারে তদন্ত করে ঐ ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন, ঐ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায় নিরূপণ করা জরুরি। মাননীয় আইনমন্ত্রী সংসদের আলোচনার বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে ‘জাতীয় তদন্ত কমিশন’ গঠনের কথা বলেছেন। মুজিববর্ষে সংসদের আলোচনায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ বহু সিনিয়র সংসদ সদস্য এই দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার জাতীয় এই শোক দিবসে কেবল তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, মিলাদ অনুষ্ঠান, কাঙালিভোজ ও আলোচনা সভা করেই শেষ করা ঠিক হবে না। এ বছর জাতীয় শোক দিবসে সকল জায়গা থেকে এই ‘জাতীয় তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবি তুলতে হবে। তা না হলে দেশে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মাঝে মাঝেই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, সাত দিনের মধ্যে সরকার ফেলে দেয়ার হুংকার দেয় তার স্বরূপ উন্মোচন করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। এখনই সময় অঙ্কুরেই তার বিনাশ সাধন। বাংলাদেশে আরেকটি পনেরই বা একুশে আগস্ট ঘটতে দেয়া যাবে না।
১৫। বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ব্যক্তি হত্যা ছিল না। ছিল না কিছু ‘বিপথগামী সেনা সদস্য’র হঠকারিতা। এই হত্যার জন্য ’৭২ সাল থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট তার বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পথভ্রান্ত হয়েছে, সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে অস্পষ্টতা রেখে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলংকমুক্ত করা যাবে না, শংকামুক্ত করা যাবে না।”
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত মহান এই সংগ্রামী নেতা ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনটি জাতীয় শিশু কিশোর দিবস হিসাবেও উদযাপিত হয়। এ বছরের দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুদের চোখ সমৃদ্ধির স্বপ্নে রঙিন।’
স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন ও অভিবাদন জানিয়ে যে কথা স্পষ্ট করেই বলতে হয়, তিনি বেঁচে থাকবেন অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সামগ্রিক মুক্তির জন্য জনগণের সংগ্রামের মাঝে।
বাঙালি জাতি ও জনগণের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এক অনন্য ভাষণ। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ওই ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
এ দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চ দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীতে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। একইভাবে এ ভাষণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান শুধু নয়। এটি অন্যান্য জাতিস্বত্বাসহ সকল স্তরের জনগণের সামগ্রিক মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক-নির্দেশনা।
এ দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা।’
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে।
ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ভাসানী) ও এর অন্তর্ভুক্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি, ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় অংশগ্রহণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। লাখ লাখ মানুষের গগন বিদারী শ্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত্ পত্ করে ওড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। শপথের লক্ষ বজ্রমুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে। সেদিন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…।’ এর পর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা ।’
মাত্র ১৮-১৯ মিনিটের ভাষণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকান্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলা মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’
তিনি বলেন, ‘আমি বলে দিতে চাই-আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দু’টি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা’।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর একটি নিবন্ধে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছেন। রণকৌশলের দিক থেকে এই ভাষণ অসাধারণ। এই বক্তৃতা এখনো মানুষকে শিহরিত করে। এই বক্তৃতার আগে রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে যে পাকিস্তানি সেনা শাসকরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাবে, সে বিষয়েও তিনি অবহিত ছিলেন।
আনিসুজ্জাামান লিখেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন কি-না, এমন এক প্রশ্নর জবাবে বঙ্গবন্ধু নিউজউইকের এক সাংবাদিককে বলেছিলেন ‘আমরাতো সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিমাদের উপর নির্ভর করছে তারা বিচ্ছিন্ন হতে চায় কি-না।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং সেই সভায় উপস্থিত তোফায়েল আহমেদ একটি নিবন্ধে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর চশমাটা সেদিন ডায়াসের উপর রেখে ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার পুরোটাই অলিখিত। একদিকে তিনি পাকিস্তানীদের প্রতি চার দফা শর্ত আরোপ করলেন, অন্যদিকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বললেন। ভাতে মারার কথা বললেন, পানিতে মারার কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। একজন তাঁকে বললেন, জনগণ কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া মানবে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি তোমার কাজ কর। আমি তাদের নেতা, আমি তাদের পরিচালিত করবো, তারা আমাকে নয়।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরে ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পর গোটা বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের পরিবর্তে বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকে বিভিন্ন জায়গায় পূর্ব পাকিস্তান শব্দ মুছে বাংলাদেশ লেখে।
তিনি বলেন, এ ভাষণের পর গোটা দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলতে থাকে। এ ভাষণ গুটি কয়েক রাজাকার ছাড়া গোটা বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গিয়ে বলতে হয়, অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে’।
’তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। তিরিশ লাখ মানুষের জীবনদানসহ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারি হিসাবে লাখ, বেসরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, পনের লাখেরও বেশি মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর হাতে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে শরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ভিত্তি।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ডে লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।
পাকিস্তানি শাসকচক্র ২৩ বছরের শাসনকালে বাঙালির যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। জন্মলগ্নেই এই কৃত্রিম অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল যখন ’৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ বাংলা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির ভেতর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতা ও ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত মাস। ’৪৮-এর মার্চে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল।
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয় ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চূড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি রফিক, জব্বার ও বরকতসহ অগণিত ভাষাশহীদের আত্মদানে। এই ভাষা আন্দোলনের পলল জমিতে বেড়ে উঠেছে নব আঙ্গিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালিত্বের পরিচয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠলেও অচিরেই বাংলার রাজনীতিও এই চেতনায় উদ্ভাসিত হয়।
ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে মূল্যায়ন করা হয় সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা হিসেবে। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে। হিটলারের নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছিল জার্মান জাতীয়তাবাদের উগ্রতা থেকে। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ সেমেটিক ইহুদিরা হলেও যা কিছু প্রগতি ও উদারনৈতিকতার সমার্থক সবই নাৎসিদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়। আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। বাঙালিত্বের চেতনা মূর্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রচনা ও গানে, যখন তিনি লিখেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ প্রভৃতি গানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা নানারূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। নাৎসি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সব সময় বিদ্বেষ নয় সম্প্রীতির কথা বলেছে। ছয়শ বছর আগে বাংলার কবি চণ্ডিদাস লিখেছিলেন ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ দেড়শ বছর আগে বাংলার আরেক মরমী কবি লালন শাহ লিখেছেন ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আর খৃস্টান/ জাতিগোত্র নাহি রবে।’ প্রায় একশ বছর আগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন/কাণ্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাঞ্জাবি শোষক চক্র বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক শোষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ২৩ বছরের সীমাহীন শোষণে পশ্চিম পাকিস্তানের উষর মরুভ‚মি হয়েছে শস্য শ্যামল এবং সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল শ্মশানে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন এই প্রশ্নের উত্তর বাঙালি খুঁজে পেয়েছে মধ্য ষাটে আওয়ামী লীগের ছয় দফায়। বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছে সত্তরের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সকল হিসাব ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাত বিভিন্ন অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে। ষাটের দশকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব সমাজতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয় করেছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি, ন্যাপ (ভাসানী ও মোজাফফর)সহ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা বিশাল।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা, বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবার আহ্বান জানান। ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।’ তারপরই বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই একটি আহ্বান সমগ্র জাতির চেতনায় স্বাধীনতা ও শোষণ-পীড়ন মুক্তির যে বোধ সঞ্চারিত করে তা মূর্ত হয়েছে পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে, যা ছিল সার্বিক অর্থে একটি গণযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখবার জন্য নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জনপদ ধ্বংসসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের এই নৃশংসতার প্রধান দোসর ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নামক উগ্র মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের দল। ইসলামের দোহাই দিয়ে এই সব দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যেভাবে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে প্ররোচিত করেছে নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী। এইসব ঘাতক দলের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও কামরুজ্জামানরা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালিদের হত্যা করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং দলের কর্মীদের প্ররোচিত করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সেই সময় প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এর প্রতিদিনের পাতায়। জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে জামায়াতিরা তখন যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে ইসলামের নামে। এভাবেই তারা ইসলামকে হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন ও ধ্বংসের সমার্থক শব্দে পরিণত করতে চেয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন তারা জামায়াতের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ঘটনাকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েও জামায়াতিরা তাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তান রক্ষা করতে পারেনি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা তালিকা তৈরি করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতারা যারা সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্যরা দেশের ভেতর আত্মগোপন করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতিদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছিল।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি।… শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কীসের এত মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য…। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের এই চার মূলনীতিকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা অর্জিত হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
৪ নভেম্বর (১৯৭২) গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু এক অনন্যসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। আমার মতে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বরের এই ভাষণ, যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নতুন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যে সব দেশে চলেছে, দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সাথে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক সিডিউলে রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারোর সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয় আমরা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাট কল, চিনির কারখানা সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষকগোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৪ নভেম্বরের ভাষণে বলেছেন ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি; এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা ঐগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের জন্মভ‚মি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্র গাছের ফল নয় অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায়। এবং সেজন্য পহেলা স্টেপ- যাকে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি; শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে, এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভূমি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান, দেখা যাবে, ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না; তা যারা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না যেমন তা পড়ে আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয় দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশ্যালিজম এনেছে তারাও সেগুলো করতে পারেননি, এ ব্যাপারে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু প্রচলন করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা প্রসেসের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
অনেকে বলেন ১৯৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রভাবে। কমিউনিস্ট না হয়েও যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করা যায় এটি বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের ভাষণে স্পষ্ট। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সমাজতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তাঁর অবস্থান একাধিক স্থানে স্পষ্ট করেছেন ‘আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান। শোষক শ্রেণিকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে প্রদত্ত ৪ নভেম্বরের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। … মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।’
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শুধু সামরিক পরাজয়ই হয়নি, তাদের ধর্মের নামে রাজনীতি, হানাহানি, হত্যা ও ধ্বংসের দর্শনেরও পরাজয় ঘটেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল সকল ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালিত্বের চেতনায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালিত্বের এই চেতনার প্রধান রূপকার, যার ভিত নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির এই ঐক্য পাকিস্তান ভেঙেছে, ধর্মের নামে রাজনীতির অমানবিক ধারণা ভেঙেছে। পরাজিত পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙালির এই ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য প্রথমে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীদের হত্যা করে পাকিস্তানের সেবকদের ক্ষমতায় বসিয়েছে, ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে বাঙালিত্বের চেতনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধর্মকে, যা তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা থেকেই করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাসের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির জনক জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি-বাংলাদেশী, ধর্মনিরপেক্ষতা-ইসলাম (রাজনৈতিক), সমরতন্ত্র-গণতন্ত্র প্রভৃতি দ্বন্দ্বে বিভক্ত করেছেন। ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ানস’ এই ঘোষণা দিয়ে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বলে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক আদর্শকে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশ ঘটানোর পাশাপাশি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির এই বিভাজন ঘটানো হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে অধিকাংশ সময় এ দেশটি শাসন করেছে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পাকিস্তানিকরণ/মৌলবাদীকরণ/ সাম্প্রদায়িকীকরণ আরম্ভ হয়েছে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি প্রায় এক যুগ একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা ’৭১-এর চেতনায় ফিরে যেতে পারিনি। ’৭২-এর সংবিধানে জেনারেল জিয়া কর্তৃক বাতিলকৃত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হলেও এখনও সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক থেকে সংবিধানকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায়নি। সেখানেও বাধা হচ্ছে বিভাজনের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রাবল্য।
’৭২-এর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৪৮ বছর এবং পাকিস্তানের ৭২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমগোত্রীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। ’৭২-এর সংবিধান এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শ মান্য করতে হলে ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত রাখতে হবে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও হত্যা বন্ধের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য।
বাংলাদেশ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি বৈষম্যহীন উন্নত ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জেহাদ বিধ্বস্ত বিশ্বে মানবকল্যাণ ও শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায় তাহলে ভবিষ্যত বিপ্লবের জন্যই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যাকে ‘৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলা হয়, তা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন ও অনুসরণ ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। আর তাইতো সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল সব শক্তি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।” #
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)
Post Views:
৩,১৫০