শুভ জন্মদিন স্যার

প্রকাশিত: ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২৪

শুভ জন্মদিন স্যার

Manual7 Ad Code

ফজলুল বারী |

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ২৩ জুন তাঁর ৮৯তম জন্মদিন। শুভ জন্ম দিন স্যার। আমাদের প্রজন্মের পড়াশুনার জগত যাদের লেখা পড়ে পড়ে শুরু হয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার তাদের অন্যতম।

স্কুল জীবনে যখন দৈনিক সংবাদ পড়তাম সেখানে একজনের লেখা পড়তে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কলামটির শিরোনাম ছিল ‘সময় বহিয়া যায়’। দেশ বিদেশের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে কী নির্মোহ বিশ্লেষন! লেখক গাছ পাথর!

মননে মেধায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন। কিন্তু তাঁর লেখায় তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনেরও সমালোচনাও থাকতো। বড় হয়ে জানতে পারি এই গাছ পাথর’ এর নেপথ্যের মানুষটিই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

দৈনিক বাংলায় তখন তাঁর আরেকটি কলাম ছাপা হতো ‘উপরে ওঠার কাঠামো ভিতরেই’। তাঁর শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন পড়ে পড়েই অনেক কিছু শেখা হয়ে যায়। তাঁকে পড়তে গেলে আরেকটি তথ্য আমাকে অবাক মুগ্ধ করতো।

তাহলো তিনি দেশেবিদেশে পড়াশুনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক, কিন্তু কি চমৎকার বাংলা লিখেন! বলেনও চমৎকার। আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর লেকচার শুনেও বিরক্ত হবেননা।

নানা বিষয়ে তাঁর কথা সামনা সামনি আমি অনেক শুনেছি। এবং আমার সৌভাগ্যটি হয়ে যায় বিশেষ একটি কারনে। এরশাদ আমলে আমি সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি নামের একটি পত্রিকায় কাজ করতাম।
ঢাকার শান্তিনগর মোড়ের একটি ভবনের পাঁচতলায় অফিস। ভবনটিতে তখন লিফট নেই। সেই ভবনের সিঁড়ি ভেঙ্গে দেশের একদল সিনিয়র বিপ্লবী সৎ মানুষ শিক্ষক সপ্তাহে একদিন বৈঠকে আসতেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান পত্রিকাটির সম্পাদক। নয়া পদধ্বনি পত্রিকাটি তাদের বিপ্লবের স্বপ্ন মুখপত্র! অধ্যাপক আহমদ শরীফ সে দলে উচ্চকন্ঠ নাস্তিক।
বাংলা ভাষা সাহিত্যের পন্ডিত। তিনি এবং অন্যরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে চলেন। পত্রিকার সাপ্তাহিক সভায় আরও আসতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুল মতিন, বিনোদ দাশ গুপ্ত, সৈয়দ আবুল মকসুদ, শাহরিয়ার কবির, আহমেদ মুসা সহ আরও অনেকে।

আমি সেখানে সবচেয়ে জুনিয়র। একমাত্র চাকুরে সাংবাদিক। এদের সঙ্গে এদের অধীনে কাজ করতে পারা সৌভাগ্য ছাড়া আর কি! স্যাররা লিখতেন কলাম। শাহরিয়ার কবির লিখতেন ভ্রমন কাহিনী।

সাপ্তাহিক সভায় যে সব রিপোর্ট নিয়ে আলাপ হতো সে রিপোর্টগুলো করার দায়িত্ব ছিল আমার। শাহরিয়ার কবির তখনও বিচিত্রায় কাজ করেন। আর কপি দেখতেন এডিট করতেন নয়া পদধ্বনির সব রিপোর্ট।
বিচিত্রায় যে রিপোর্টগুলো করা সম্ভব ছিলোনা সেই রিপোর্ট তিনি নয়া পদধ্বনিতে করাতেন। খবর গ্রুপের সাপ্তাহিক মনোরোমায় হঠাৎ করে তখন এরশাদের বান্ধবী জিনাত মোশাররফকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ রিপোর্ট ছাপা হয়।

Manual1 Ad Code

জিনাত এভাবে পত্রিকা পড়েন, জিনাত এভাবে দেশ জাতি নিয়ে চিন্তা করেন, জিনাত এভাবে ত্রান দেন, এমন নানান ছবি নিয়ে ফরমায়েশি রিপোর্ট! তখন আমরা নয়া পদধ্বনিতেই আমি রিপোর্ট করি, ‘কে এই জিনাত মোশাররফ’।

ওই রিপোর্ট ছাপার পর সিটি এসবির অফিসে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাদের স্যার মোখলেসুর রহমান আমার সঙ্গে চা খাবেন! মোখলেসুর রহমান আমাকে বললেন, ‘এটা লিখেছেন কেনো? জানেননা এসব লিখলে আমাদের অসুবিধা হয়।
আর লিখবেননা’। আমি বললাম আসলেই আর লিখবোনা। কারন আমার কাছে আর লেখার মতো তথ্য নেই। যা তথ্য ছিল সব লিখে ফেলেছি’। মোখলেসুর রহমান আমার দিকে হা তাকিয়ে থাকেন।

Manual4 Ad Code

অফিসে ফেরত আসার পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারকে ফোন করে ঘটনা বললে তিনি চিন্তিত কন্ঠে বলেন সিরিয়াস ব্যাপারতো। এভাবে ধরে নিয়ে গেলো! এরপর সব শুনে সাব্বাশি দিয়ে বললেন, তুমি দারুন একটা কাজ করেছো বারী।

এভাবে এই স্যারদের তত্ত্বাবধায়নে ভালোবাসায় রিপোর্টার হিসাবে আমি গড়ে উঠেছি। নয়া পদধ্বনিতে আমার মাসিক বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। স্যাররা পত্রিকায় লেখার জন্যে তিনশ টাকা বিলের দেড়শ টাকা নিতেন।

Manual1 Ad Code

দেড়শ টাকা বিপ্লবের জন্যে পত্রিকার তহবিলে দান করতেন। এই সিনিয়র বিপ্লবীদের তখন আরেকটি সংগঠন ছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’। এই সংগঠনের ব্যানারে তখন ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ বইটি বের হয়।

পেপারবেক বইটি তখন তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। এই বিপ্লবীরা জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনামল থেকেই এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন শুরু করেন। তারা কোন রাজনৈতিক দল করতেননা বলে তাদের প্রচার ছিলোনা।
তাদের পিছনে হাজার হাজার মানুষ ছিলোনা। কিন্তু হাজার হাজার পাঠক ছাত্র তাদের ছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’, ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ এর ধারাবাহিকতায় পরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।

আজকের এই আন্দোলনের যত পাইওনিয়ার তাদের অনেকে হয়তো তখনও জন্মগ্রহন করেননি অথবা তারা তখনও শিশু। কিন্তু স্বপ্নটা কিন্তু তারাই শুরু করেছিলেন। তাদের স্বপ্নের সেই আন্দোলন পূর্নতা পেয়েছে শেখ হাসিনার হাতে।

শেখ হাসিনা ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের এভাবে বিচার-ফাঁসি হতোনা। আওয়ামী লীগের কত নেতা যে কত যুদ্ধাপরাধীর মালকড়ি খেয়ে পেট মোটা করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে কেনা যায়না বলে তাদের ফাঁসি ঠেকানো যায়নি।

যে কারনে কত যুদ্ধাপরাধীদের ছেলেমেয়েরা সেই টাকাখোর নেতাদের এখনও নিমক হারাম, বেঈমান, পচা বলে গালি দেন আর কাঁদেন। বুদ্ধিজীবীদের এই গ্রুপের ছায়ায় তত্ত্ববধানে গড়ে ওঠে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বের চরিত্রটি।

একাত্তরের ডায়েরির সঙ্গে বিচিত্রা-দৈনিক বাংলার লাইব্রেরিতে জোগাড় করা তথ্যের ঘষামাজায় সৃষ্টি হয় শহীদ জননীর অমর সৃষ্টি একাত্তরের দিনগুলি। ১৯৮৬ সালে ছাপা সেই বই মূলত এই মায়ের নেতৃত্বে আন্দোলনের পথ তৈরি করে।

১৯৩৬ সালের ২৩ জুন মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে জন্ম হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। পড়াশুনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

Manual5 Ad Code

যুক্তরাজ্যের লিডস এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। তাঁকে উপাচার্য করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট দু’বার মনোনীত করেছিল।
কিন্তু দু’বারই তিনি সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। কারন তিনি জানেন উপাচার্য হয়ে গেলে পড়াশুনা, লেখালেখি, পড়ানো এই কাজগুলো নীরবে নির্বিঘ্নে করা যায়না। উপাচার্য মানেই কিছুদিনের মধ্যে একটি বিতর্কিত চরিত্র!

আর আমাদের দেশের দলবাজ শিক্ষকদের উপাচার্য হতে কি রকম দৌড় প্রতিযোগিতা চলে নিত্য! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজমা জেসমিন চৌধুরী ছিলেন তাঁর স্ত্রী। সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজ মহলের জন্যে তাজমহল বানিয়েছেন।
আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর প্রয়াত প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেন নাজমা জেসমিন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা। বিদ্বান লোকজনের ভালোবাসার প্রকাশ বুঝি এভাবেই হয়।

বাংলাদেশের কিছু লোকজন মাঝে মাঝে বিতর্ক করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছেন! একাত্তরে আরও অনেকে অনেক কিছু করেছেন। অনেকের অনেক ভূমিকা দেশের জন্যে ক্ষতিকরও ছিল।
কিন্তু এখন পক্ষে থাকায় তাদের নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই! সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আমি যতটা দেখেছি তাঁকে একজন ভীতু প্রকৃতির মানুষও মনে হয়েছে। কবি শামসুর রহমানও বলেছেন সাহসের অভাবে তিনি যুদ্ধে যাননি।

‘স্বাধীনতা তুমি’ অমর কবিতাটিও যুদ্ধে না যাওয়া শামসুর রাহমানের লেখা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র গবেষনা প্রবন্ধ। তিনি একজন দূর্নীতিমুক্ত বিশাল ব্যক্তিত্ব। শুভ জন্মদিন স্যার। সুস্থ থাকুন। আরও দীর্ঘায়ু হোন।
#

ফজলুল বারী
লেখক, সাংবাদিক
সিডনি (অস্ট্রেলিয়া)
২৩ জুন ২০২৪

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ