জঙ্গি আক্রমণ থেকে হুজুগে বর্বর ধর্ম-সন্ত্রাস (Terrorism to Mob Vandalism): কেন হেফাজত এত আগ্রাসী?

প্রকাশিত: ১:৫৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০২১

জঙ্গি আক্রমণ থেকে হুজুগে বর্বর ধর্ম-সন্ত্রাস (Terrorism to Mob Vandalism): কেন হেফাজত এত আগ্রাসী?

Manual2 Ad Code

।। খান আসাদ ।।

০২ এপ্রিল ২০২১ : বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে ১৩৩ টি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। কোনটা কতটা শক্তিশালী বা একই দল ভিন্ন ভিন্ন নামে কিনা, এই সব আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন আছে। এরা মূলত ট্রান্সন্যাশনাল। বাংলাদেশে আলকায়েদা ও আইসিস (ইসলামিক ষ্টেট ইন ইরাক এন্ড সিরিয়া) যে সক্রিয় তা তাঁদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশে যে জঙ্গিদল রয়েছে, প্রায় সবগুলোর সাথেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠনের সম্পর্ক আছে। এরা একটি নেটওয়ার্কের আওতায়।

বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিদল একটি “ইসলামী রাজনীতির” সহযোগী শক্তি। যেমন ১৯৭১ সালে “ইসলাম” রক্ষার জন্য রাজাকার আলবদর আলশামস নামের সামরিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশের ভেতরে যে ইসলামী সংগঠন, তারাও মূলত বাইরে থেকেই গড়ে তোলা। প্রধানত মার্কিন-সৌদি-পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায়। আফগানিস্তানে “রাশিয়ান ইনভেশন” ঠেকানো ছিল একটি যুক্তি।

Manual6 Ad Code

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সাথে সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলামী মৌলবাদ সম্পর্কিত, একটি অখণ্ড ধারা। এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, শরিয়া আইন চালু, ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পুরুষ আধিপত্য কায়েমের। এই রাজনীতি অক্টোপাসের মত, অনেকগুলো হাত পা আছে, যারা নানা সেক্টরে কাজ করে। এরা নানা রাজনৈতিক দলে ও সরকারী প্রশাসনেও আছে। এরা সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলো দখলে নিতে চায়। সামরিক শাখার কাজ হচ্ছে, জঙ্গি আক্রমণ।

Manual3 Ad Code

২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ২২ জন বিদেশী নাগরিক হত্যার পর, বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্রধানত জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত করার আন্তরিক উদ্যোগ নেয়। যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখা যায়, ২০১৬ থেকে জঙ্গি হামলার সংখ্যা কমতে থাকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তৎপরতায়।

ইন্টারেস্টিং যে ২০১৭ সালে এরা ৭, ২৪ ও ২৫ তারিখে হামলা করে, যেখানে সিলেটে ৮ জন নিহত হয় ও ৪০ জন আহত হয়। ২০১৮ সালেও এরা অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপর হামলা করে ৩ রা মার্চ। এদের হামলার পছন্দের মাস ফেব্রুয়ারি (অভিজিত, রাজীব), মার্চ ও আগস্ট। কেন তা মনে হয় বুঝিয়ে বলতে হবেনা।

Manual1 Ad Code

পুরো উপমহাদেশেই জঙ্গিবাদী হামলা অনেক কমে গিয়েছে, বেড়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আনুপাতিক হারেই। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বাড়ার জন্য প্রতি বছর নানা রকম নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে অনেক খরচ হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্ষমতা বাড়ানোর যুক্তি জঙ্গিবাদ দমন। কিন্তু এর কিছু পার্শ প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যেমন এই সব বাহিনী দ্বারা বেআইনি হত্যাকাণ্ড, শ্রমজীবীদের আন্দোলন দমন ও আদিবাসীদের জমি দখলে ভূমিদস্যুদের সহায়তা দেয়া।

সাম্প্রতিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে হেফাজতের তাণ্ডব, তা বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশ জঙ্গিবাদ দমনের সাথে সম্পর্কিত। যেহেতু “ইসলামী” আন্দোলনটি তার সামরিক কার্যক্রম ভালভাবে চালাতে পারছেনা, এরা এখন অন্য কৌশল নিয়েছে। যে কৌশলের নাম মব ভ্যান্ডালিজম বা হুজুগে সন্ত্রাস। এরা এদের সহিংস সক্রিয়তা বজায় রাখার জন্য এই নতুন পথ বেছে নিয়েছে।এই মার্চে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে না এলেও, এরা মার্চমাসে কিছু না কিছু একটা করতোই।

Manual8 Ad Code

জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করার জন্য কাউন্টার টেররিজম ইউনিট রয়েছে, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বা হাটহাজারিতে যা হলো, তা আগে থেকেই অনুমান বা মোকাবিলার কৌশল তাঁদের নাও থাকতে পারে। অথবা হতে পারে, সরকার সীমিত মাত্রায় মব ভায়োলেন্স হতে দেবে, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে (এক্ষেত্রে বিএনপি) কোণঠাসা করতে। আমি নিশ্চিত নই।

আগামী বিপদ কি?

এক, রাষ্ট্রযন্ত্র ও জাতীয় এলিটেরা (থিঙ্কট্যাঙ্ক) মনে করে তাঁরা জঙ্গিবাদ দমনে সক্ষম, যেটা তাঁদের ব্যাবসার পরিবেশের জন্য দরকার। কিন্তু জঙ্গিবাদ একটি ট্রান্সন্যাশনাল ব্যাপার। যেমন ভারত দায়ী করে পাকিস্তান ও চিনকে, আবার পাকিস্তান দায়ী করে ভারতকে, নিজ দেশের জঙ্গি তৎপরতার জন্য। যদি দক্ষিণএশিয় দেশের বর্তমান ভারসাম্য বদলে যায়, যেমন মিয়ানমারে এসেছে সামরিক জান্তা, তখন যদি জঙ্গিবাদ নোতুন রসদ বাইরে থেকে পায়, তাহলে আবার আগের মত সক্রিয় হবে।

দুই, যেহেতু এরা জঙ্গিবাদী কার্যক্রম করতে বাধা পাচ্ছে, এদের নোতুন কর্মক্ষেত্র হবে সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ও প্রকাশ্য মব ভায়োলেন্স। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেই ইংগিত দেয়। এরা স্থানীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী, সেক্যুলার সংস্কৃতি কর্মী তথা সফট টার্গেট বেছে নেবে, প্রকাশ্যে হামলা করবে। রাস্তায় প্যান্ট খুলে দেখবে খতনা করা আছে কিনা। নারীর চুল দেখা যায় কিনা। অর্থাৎ সমাজে এদের সহিংস আধিপত্য বেড়ে যাবে।

দুর্নীতি ও অবিচার, সংস্কৃতি কর্মীদের উপর রাষ্ট্রের নিপীড়ন, শ্রেণি শোষণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বেআইনি হত্যা সহ নানা বিষয়ে যে সঙ্কট বা অপশাসন রয়েছে তার কারণ ব্যক্তি হিসেবে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং “ফ্যাসিস্ট” আওয়ামীলীগকে দায়ী করার একটি প্রচার রয়েছে। প্রধানত বিএনপি-জামাত ও প্যাথলজিকাল আওয়ামীবিরোধীদের দিক থেকে। অর্থাৎ, অন্য কথায়, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, অবিচার, অপশাসন, বৈষম্য ও নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে, ব্যক্তি হিসেবে সরকার প্রধান ও দল হিসেবে আওয়ামীলীগের পতন হলে। এটি এদের ক্ষমতার হাত বদলের বা রেজিম চেঞ্জের রাজনীতি।

আজকের বাংলাদেশ একটি নতুন পর্বে এসেছে। সাল্লা, হাটহাজারি কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা যা দেখছি, তা একটি নতুন প্রবণতা যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে বলে আমার ধারনা। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী কি করবে আমরা নিশ্চিত নই। এই প্রেক্ষাপটে, বামপন্থীদের কার্যকর ভূমিকা নির্ধারণের সময় এসেছে। যে ব্যবস্থা এই সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের ভিত্তি, সেই ব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতি এবং একই সাথে আশু হুমকি মোকাবেলার জন্য যুগোপযোগী রাজনীতি এখন সময়ের দাবী।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code