ইরান-চীন সম্পর্কে আতঙ্কিত ভারত, দুই মন্ত্রী তেহরানে

প্রকাশিত: ৬:৪৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০

ইরান-চীন সম্পর্কে আতঙ্কিত ভারত, দুই মন্ত্রী তেহরানে

তেহরান (ইরান), ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ : ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত সপ্তাহে অনেকটা নীরবেই তেহরান সফর করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তেহরানে নামেন মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা জোটের বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার পথে। জয়শঙ্কর মস্কো থেকে ফেরার পথে মঙ্গলবার সারাদিন তেহরানে কাটান।

নীরবে এই সফর নিয়ে সরকারীভাবে রিফুয়েলিং অর্থাৎ বিমানে তেল ভরার যুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের দুই মন্ত্রী সেই তেল দুবাই বা আবুধাবিতে না ভরে তেহরানে কেন নামলেন? পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই যে চিরশত্রু চীন এবং হালে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরান যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ভারত তাতে গভীর উদ্বিগ্ন।
দিল্লির জওহারলাল নেহেরু ইউনিভারসিটির (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, চীনের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা বাড়ছে। ভারতের কাছে ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত কোনোভাবেই তা খোয়াতে চায় না।
অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্ব বিশাল। সে কারণেই ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়েছিল ভারত। জ্বালানির জন্য এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ইরানের মত প্রভাবশালী একটি মুসলিম দেশের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ভারত উদগ্রীব।
কিন্তু এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে ভারত ও ইরান যে ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে তা স্পষ্ট। বিশেষ করে যে দেশটি এখন ভারতের সবচেয়ে শত্রু দেশে পরিণত হয়েছে সেই চীনের সঙ্গে ইরানের যে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে, তা ভারতের কাছে দু:স্বপ্ন। তবে ইরান ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব একদিনে তৈরি হয়নি।

গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে, ইরানের সঙ্গে ততই দূরত্ব বেড়েছে। সেই শূন্যতা পূরণে ঝড়ের মত ঢুকে পড়েছে চীন। চীন এবং ইরান তাদের মধ্যে ২৫ বছরের একটি কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তি নিয়ে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে জানা গেছে।

নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে যা জানা গেছে এই চুক্তিতে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের যে বন্দরটির উন্নয়নের শুরু ভারতের হাতে হয়েছে সেই চাবাহার বন্দরের সম্প্রসারণ এবং ওই বন্দরের সঙ্গে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের রেল যোগাযোগের কাজ এখন চীনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে ইরান। শুধু তাই নয়, জানা গেছে চীন এখন চাবাহার বন্দরটিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ করতে উদগ্রীব।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক রাকেশ সুদ বলেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় চাবাহার বন্দর উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি পূরণে ভারতের গড়িমসিতে ইরান ক্ষুব্ধ। সেই সাথে যোগ হয়েছে এশিয়ায় জোট রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের প্রভাব।

রাকেশ সুদ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে রাশিয়া এবং চীনের দৃষ্টিভঙ্গি এখন একইরকম। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যে সব দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে- ইউএই এবং সৌদি আরব- তারা ইরানের বড় শত্রু।’

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের আগ্রহে পাকিস্তানের সাথে ইরানের সম্পর্কে যেভাবে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে তা ভারতের জন্য বাড়তি মাথাব্যথা। কারণ, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে ভারত তাদের প্রভাব কতটা ধরে রাখতে পারবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের আয়োজনে পাকিস্তান নিয়ে এক অনলাইন আলোচনায় সেদেশের প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, প্রধানত অর্থনৈতিক স্বার্থে ইরানের সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে পাকিস্তানের ভেতর আগ্রহ বাড়ছে।

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের স্বার্থকে নতুন করে পর্যালোচনা করছে এবং পাকিস্তানের চাইতে ভারত তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইরান এখন পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’

তাহলে ভারত কি তাদের একসময়কার ঘনিষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু দেশে ইরানকে একেবারেই হারিয়ে ফেলছে? অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে তা জেনেও দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে তেহরানে পাঠিয়ে ভারত বোঝাতে চেয়েছে যে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত বার্তা দিতে চাইছে যে পররাষ্ট্র নীতি এবং কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিল্লীর নীতি এখনও স্বাধীন। এ ব্যাপারে তারা আপোষহীন।

তিনি বলেন, ভারতের মত বড় একটি বাজার সবসময়েই ইরানের জন্য লোভনীয় এবং ইরান নিশ্চয়ই জানে যে তাদের জ্বালানি তেলের পুরোটাই চীন কিনবে না। কিন্তু আমেরিকা এবং চীনের রেষারেষিকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে দলাদলি শুরু হয়েছে ভারত-ইরান সম্পর্ক যে তার বলি হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ